যুদ্ধ তীব্র হলেও ইউক্রেনে রাশিয়ার অগ্রযাত্রা ক্রমশ কমছে, এমনটাই দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন বিশ্লেষণে। যদিও রাশিয়া তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে, তারপরও তাদের ভূখণ্ড দখলের গতি কমে গেছে।
একদিকে যেমন দেশ দুটি আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা করছে, তেমনই উভয় পক্ষই নিজেদের শক্তি প্রদর্শনে ব্যস্ত।
ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের হিসাব অনুযায়ী, মার্চ মাসে রাশিয়া ইউক্রেনের ১৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করেছে। যেখানে ফেব্রুয়ারিতে তারা ১৯৬ বর্গকিলোমিটার এবং জানুয়ারিতে ৩২৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করতে পেরেছিল।
ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার’ একই ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করেছে। তাদের মতে, মার্চে রাশিয়ার দখলে গেছে ২০৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা, ফেব্রুয়ারিতে ৩৫৪ বর্গকিলোমিটার এবং জানুয়ারিতে ৪২৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা।
স্যাটেলাইট চিত্র এবং উন্মুক্ত সূত্র থেকে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে এই হিসাব দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে গ্রীষ্মের শুরুতেই রাশিয়ার অগ্রযাত্রা প্রায় থেমে যেতে পারে। এমনটা হলে, তা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির সময়সীমার সঙ্গে মিলে যেতে পারে।
রাশিয়া তাদের সৈন্য সংখ্যা অনেক বাড়িয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন তারা প্রথম আক্রমণ শুরু করে, তখন তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় লাখ।
বর্তমানে সেই সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ইউক্রেনের সামরিক কমান্ডার-ইন-চিফ ওলেksander Syrskii এর মতে, রাশিয়া প্রতি বছর ইউক্রেনে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার সৈন্য যোগ করছে।
বর্তমানে সেখানে তাদের প্রায় ৬ লাখ ২৩ হাজার সেনা সদস্য রয়েছে।
তবে রাশিয়ার সৈন্যদের এই বিশাল বহর সত্ত্বেও, তারা ইউক্রেনের খুব সামান্য অংশই দখল করতে পেরেছে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর থেকে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এলাকা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
২০২৩ সালে ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণে প্রায় ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা পুনরুদ্ধার করা হয়। রাশিয়া এখনও সেই এলাকাগুলো পুনর্দখল করতে পারেনি।
গত বছর ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় ডনেৎস্কে তাদের অভিযান ছিল খুবই ধীরগতির। সেখানে তারা মাত্র ৪,১৬৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করতে পেরেছিল, যা ইউক্রেনের মোট এলাকার ০.৬৯ শতাংশের সমান।
তবে এই সামান্য অগ্রগতির জন্য রাশিয়াকে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধে রাশিয়ার প্রায় ৪ লাখ ৩০ হাজার ৭৯০ জন সৈন্য নিহত হয়েছে।
যা ২০২২ এবং ২০২৩ সালের সম্মিলিত ক্ষতির চেয়েও বেশি। যদিও রাশিয়া তাদের সৈন্যের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন সৈন্য নিয়োগ করছে, তবে তাদের সেনাদের প্রশিক্ষণ এবং সরঞ্জামের অভাব রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
ছোট ছোট এলাকা দখলের ঘোষণা দিয়ে রাশিয়া ইউক্রেন জয়ের বিষয়টি সহজ করে দেখাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, গত সোমবার রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায় যে, তারা ডনেৎস্কের কাতেরিনোভকা গ্রামটি দখল করেছে।
তবে এই জয়গুলো খুবই সামান্য। ‘ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার’ এর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমান হারে অগ্রসর হলে শুধু ডনেৎস্ক অঞ্চলের বাকি অংশ দখল করতেই রাশিয়ার দুই বছর সময় লাগবে। এমনকি, ২০২৫ সালে রাশিয়ার অগ্রগতির গতি আরও কমে যেতে পারে।
ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ থেকে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরুর পর থেকে রাশিয়ার আগ্রাসন আরও বেড়েছে। ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার ড্রোন হামলার সংখ্যা ৫০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে রাশিয়া ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী কুর্স্ক অঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের বিতাড়িত করার চেষ্টা করে। এপ্রিলের ৯ তারিখে রাশিয়া জানায়, কুর্স্কে এখন শুধুমাত্র গোর্নাল এবং ওলেশনিয়া—এই দুটি গ্রাম ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
সেগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য সেখানে তীব্র লড়াই চলছে।
কুর্স্কে রাশিয়ার সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গেই ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সামরিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া খারকিভ এবং সুমি—ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই দুটি অঞ্চলে নতুন করে হামলা শুরু করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ইউক্রেনীয় কমান্ডার-ইন-চিফ ওলেksander Syrskii জানিয়েছেন, রাশিয়া সম্ভবত শরৎকালে বেলারুশের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ার আড়ালে আরও সৈন্য একত্রিত করার চেষ্টা করতে পারে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে একজন অযোগ্য নেতা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে রাশিয়া। রাশিয়ার কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেন তাদের সঙ্গে হওয়া শক্তি অবকাঠামো সংক্রান্ত যুদ্ধবিরতি মানছে না।
যদিও কিয়েভ এই ধরনের কোনো চুক্তিতে রাজি হয়নি।
শুক্রবার রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ইউক্রেন ব্রায়ানস্ক, তাম্বভ এবং লিপেৎস্ক অঞ্চলের জ্বালানি কেন্দ্রে বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে, যার ফলে তিনটি শহরে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং দুটি শহরে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়।
রাশিয়ার বিশেষ দূত রডিয়ন মিরোশনিক তার টেলিগ্রাম চ্যানেলে লিখেছেন, “এক রাতেই রাশিয়ার মাটিতে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলা চালানোর জন্য ১০০টিরও বেশি ইউক্রেনীয় ড্রোন পাঠানো হয়েছে, যা জেলেনস্কির শান্তির আকাক্সক্ষা নিয়ে কান্নার চেয়ে হাজার গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, কিয়েভ সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এবং কট্টরপন্থী ও জাতীয়তাবাদী গ্রুপের কারণে যুদ্ধবিরতি আলোচনা কঠিন হয়ে পড়েছে।
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বৃহস্পতিবার ইস্তাম্বুলে আলোচনার কথা রয়েছে।
বুধবার রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ক্রিমিয়া উপদ্বীপের কাছে তেমরুক শহরে গ্যাস বিতরণ কেন্দ্রে হামলা চালানোর সময় দুটি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে। একই রাতে কোরে নভস্কায়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আঘাত হানার আগে আটটি ইউক্রেনীয় ড্রোন ধ্বংস করা হয়।
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ‘তুর্কস্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইনের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
এপ্রিল মাসের ৩ তারিখ রাতে ১০টির বেশি অঞ্চলে ইউক্রেনের ১০৭টি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে বলে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
তবে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, রাশিয়াও খেরসন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে স্বল্প-পাল্লার ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়েছে।
অন্যদিকে, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী অবশ্য শনিবারের হামলার বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য জানায়নি। যদিও ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলায় রাশিয়ার সারানস্কে অবস্থিত একটি অপটিক্যাল ফাইবার তৈরির কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা ড্রোন ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামের জন্য ব্যবহৃত হয়।
একইসঙ্গে, রাশিয়ার সামারা অঞ্চলের একটি বিস্ফোরক প্রস্তুতকারক কারখানায় ড্রোন হামলায় ২০টি বিস্ফোরণ হয় এবং সেখানে আগুন ধরে যায়।
ইউক্রেনের কমান্ডার-ইন-চিফ ওলেksander Syrskii জানিয়েছেন, ড্রোন হামলায় রাশিয়ার একটি ১০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের টিইউ-২২এম৩ (Tupolev-22M3) বোমারু বিমান ধ্বংস হয়েছে।
ইউক্রেন এই ধরনের বোমারু বিমানকে লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে, কারণ এগুলো ব্যবহার করে তারা ইউক্রেনীয় ফ্রন্ট লাইনে বোমা হামলা চালায়।
সyrskii আরও জানান, রাশিয়ার বিমান ঘাঁটিতে হামলার কারণে তাদের বিমান বাহিনীর কার্যকারিতা কমে গেছে। ইউক্রেন নিয়মিতভাবে সামরিক ও জ্বালানি অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে হামলা চালালেও, রাশিয়া ইউক্রেনীয় শহরগুলোতে দূরপাল্লার বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে।
শনিবারের হামলার প্রতিশোধ হিসেবে রাশিয়া ১৮টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ৬টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১০৯টি আক্রমণাত্মক ড্রোন দিয়ে হামলা চালায়। ইউক্রেন দাবি করেছে, তারা ৯৩টি ড্রোন, ১টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১২টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করেছে।
তবে ৫টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আবাসিক এলাকায় আঘাত হানে। ক্রিভি রিহ-এ একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৯ শিশুসহ ২০ জন নিহত হয়।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ব্রিগেড ব্রিঙ্ক সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “যুদ্ধ অবশ্যই শেষ হওয়া উচিত।” জেলেনস্কি টেলিগ্রামে এর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “একটি শক্তিশালী দেশ, এত শক্তিশালী মানুষ – এবং এত দুর্বল প্রতিক্রিয়া।
তারা শিশুদের হত্যা করা ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়ে ‘রাশিয়ান’ শব্দটি বলতেও ভয় পায়।
রাশিয়া অভিযোগ করেছে, জেলেনস্কি ইচ্ছাকৃতভাবে এই হামলাকে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্বিচার গণহত্যা হিসেবে তুলে ধরছেন, যদিও তারা মূলত ইউক্রেনীয় কমান্ডারদের সঙ্গে বিদেশি ভাড়াটে সৈন্যদের একটি বৈঠককে লক্ষ্য করেছিল।
ক্রিভি রিহ-এ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর রাশিয়া ড্রোন হামলা চালায়, যাতে একটি খেলার মাঠ ও আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই হামলার আগে কৃষ্ণসাগরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি অলিখিত যুদ্ধবিরতি চলছিল।
জেলেনস্কির মতে, রাশিয়ার কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র জাহাজ ও সাবমেরিন থেকে ছোড়া হয়েছিল, যার কারণে এই যুদ্ধবিরতি ভেঙে যায়।
সোমবার রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা রাতে ১৯টি ইউক্রেনীয় ড্রোন ভূপাতিত করেছে। ইউক্রেনের বিমান বাহিনী জানিয়েছে, তারা মঙ্গলবার ৪৬টি ড্রোন হামলার মধ্যে ৩১টি প্রতিহত করেছে।
একই ধরনের কৌশল অবলম্বন করে তারা ক্রিভি রিহ-এ আঘাত হানে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা