ভয়ঙ্কর বোমা হামলার মাঝেও, ইউক্রেনের শিশুদের স্কুলে ফেরা!

ইউক্রেনের শিশুরা : রাশিয়ার বোমা হামলার মধ্যে, মাটির নিচের শ্রেণিকক্ষে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে, রাশিয়ার বোমা হামলার হুমকিতে শিশুদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে অভিনব উপায় বের করা হয়েছে। দেশটির সুমি অঞ্চলের ববরিক গ্রামের স্কুলগুলোতে স্বাভাবিক পাঠদান সম্ভব হচ্ছে না।

তাই সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা এখন মাটির নিচে নির্মিত ক্লাসরুমে পড়াশোনা করছে। সোমবার থেকে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর দিনে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

ফেব্রুয়ারি ২০২২ সাল থেকে যুদ্ধ শুরুর পর, স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের পাঠদান চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন উপায় খুঁজে বের করেছে। ববরিক গ্রামটি ফ্রন্টলাইনের খুব কাছে হওয়ায় সেখানকার একটি স্কুলের ক্লাসগুলো সম্পূর্ণভাবে একটি বেসমেন্টে স্থানান্তর করা হয়েছে।

কোভিডের কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় যে ক্ষতি হয়েছিল, তা কাটিয়ে উঠতে এবং সরাসরি পাঠদানের সুযোগ করে দিতে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

আমাদের অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে যেন এই প্রজন্মের কোনো ক্ষতি না হয়। সময় তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। এটি আমাদের ভবিষ্যৎ, তাই আমাদের সবটুকু দিতে হবে।”

স্কুলের প্রধান শিক্ষক ওলেক্সি কোরেনিভস্কি

প্রায়ই ২০ ঘণ্টা ধরে বিমান হামলার সাইরেন বাজতে থাকায় দুই বছর আগে স্কুলটি মাটির নিচে স্থানান্তরিত করা হয়। তখন ক্লাসরুমগুলোতে পাঠদান প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

বোমা হামলার হাত থেকে বাঁচতে এবং পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

প্রশাসন ভবনের বেসমেন্টে কোনোমতে ক্লাসরুম তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ভালোভাবে আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা নেই। সংকীর্ণ জায়গায় কিছু প্লাস্টিকের পর্দা দিয়ে ক্লাসগুলো ভাগ করা হয়েছে।

ক্লাসরুমের ভেতরে জানালা বা দরজা কিছুই নেই। পাঠদানের সময় শিশুদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর এক ভিন্ন আবহ তৈরি করে।

নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে অনেক শিক্ষার্থী ঐতিহ্যবাহী ‘ভিসিব্যাঙ্কা’ (embroidered traditional shirts) পরে স্কুলে আসে। শিক্ষকরা তাদের টেবিলে ফুল দিয়ে সাজিয়ে তোলেন, যা নতুন বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের দেওয়া একটি ঐতিহ্যবাহী উপহার।

দুর্ভাগ্যবশত, এই ‘ প্রতিবেশী’ (রাশিয়া) কোথাও যাচ্ছে না।” পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অনেক কিছু করার আছে এবং এটি মূল্যবান বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

প্রধান শিক্ষক ওলেক্সি

আগে স্যাঁতসেঁতে ও অন্ধকারাচ্ছন্ন বেসমেন্টটি এখন ভালোভাবে সংস্কার করা হয়েছে। সেখানে পর্যাপ্ত আলো, বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা এবং নতুন মেঝে তৈরি করা হয়েছে।

রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে ইউক্রেনীয়রা তাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ববরিক গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ২ হাজার।

সেখানকার স্কুলটিতে প্রতিটি ক্লাসে প্রায় ১০ জন করে শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে এবার প্রথম শ্রেণির ক্লাসে মাত্র সাতজন শিক্ষার্থী ছিল।

প্রথম দিনের ক্লাসে শিক্ষক ইউক্রেনের একটি মানচিত্র দেখান, যেখানে দেশটির কোনো অংশকে রাশিয়ার দখলে দেখানো হয়নি।

তিনি উত্তর দিকে, সুমি অঞ্চলের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “আমাদের এই অঞ্চলটি রাশিয়ার পাশে অবস্থিত। তাই তারা প্রায়ই বোমা হামলা করে, কারণ আমরা এই কঠিন প্রতিবেশীর কাছাকাছি আছি।”

বর্তমানে স্কুলটিতে একশর বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে, তবে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসনের পর থেকে প্রায় ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। ছোট একটি স্কুলের জন্য, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর চলে যাওয়া অনেক কষ্টের।

১৫ বছর বয়সী ভ্লাদা মিখাইলিকও তার ১১ বছর বয়সী ভাইয়ের সঙ্গে শীঘ্রই অস্ট্রিয়া চলে যাবে। তাদের মা পরিস্থিতিকে আরও বেশি বিপজ্জনক মনে করছেন।

আমরা ভালো আছি, কিন্তু মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। প্রায়ই ড্রোন এবং বিস্ফোরণের শব্দ শুনি।” মাটির নিচে পড়াশোনা করা এখন তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সে আরও বলে, “অনলাইনে ক্লাস করার চেয়ে বেসমেন্টে বসে ক্লাস করা ভালো।”

ভ্লাদা

তবে ভ্লাদা শহর ছাড়তে রাজি নয়। সে তার বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যেতে চায়।

ছোট ক্লাসরুমগুলোতে যুদ্ধের বিষয়টি প্রথম দিনের পাঠের বিষয় ছিল না। গ্রীষ্মের ছুটিতে শিক্ষার্থীরা কী করেছে জানতে চাইলে তারা জানায়, সাইকেল চালানো, বাবা-মাকে সাহায্য করা, নতুন বন্ধু তৈরি করা ইত্যাদি।

তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, “আমাদের ওপর একটি ‘শায়েদ’ ড্রোন (Shahed drone) এসেছিল এবং এর কিছু অংশ আমাদের কাছাকাছি এসে পড়েছিল।”

এসব তো যুদ্ধের কারণেই হচ্ছে।”

শিক্ষক

বেসমেন্ট ছোট হওয়ায় স্কুলটি দুটি শিফটে চলে এবং বিরতির সময়ও সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। মূল স্কুল ভবনটি, যা ২০ শতকের প্রথম দিকে নির্মিত হয়েছিল, সেটি এখন খালি পড়ে আছে।

সেখানকার প্রশস্ত শ্রেণিকক্ষগুলো শিক্ষার্থীদের ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছে, যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

এভা তুই নামে সাত বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী, মাটির নিচের ক্লাসরুমে তার তৃতীয় বছর শুরু করেছে। সে জানায়, তার আগের ক্লাসরুমটি, যা প্রায় ৪০০ মিটার দূরে ছিল, শীতকালে গরম এবং আরামদায়ক ছিল।

আমরা এখানে আছি কারণ যুদ্ধ চলছে এবং অনেক সাইরেন বাজে।”

এভা

নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগের রাতে তার খুব উত্তেজনা ছিল।

এভার একটি সাধারণ ইচ্ছা : “আবার ক্লাসরুমে ফিরে যেতে চাই। এটি বাড়ির মতো মনে হয়।”

এবং তার বড় স্বপ্ন : “যুদ্ধ শেষ হোক।”

তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *