যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউক্রেনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তির শর্তাবলী নিয়ে কিয়েভে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অনেকের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগের সৃষ্টি হলেও, অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ইউক্রেন সম্ভবত এই চুক্তিতে উল্লেখযোগ্য কিছু সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে।
চুক্তিটি এখনো চূড়ান্ত রূপ নেয়নি। বিস্তারিত বিষয়গুলো একটি কারিগরি চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যা এখনো স্বাক্ষরিত হয়নি। তবে, কিয়েভ স্কুল অফ ইকোনমিকসের প্রেসিডেন্ট টাইমোফি মিলোওয়ানোভ এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, “ইউক্রেন তাদের অবস্থানে অটল ছিল। প্রবল চাপ সত্ত্বেও, অন্য পক্ষের অযৌক্তিক সব দাবি বাতিল করা হয়েছে। চূড়ান্ত চুক্তিটি ন্যায্য বলেই মনে হচ্ছে।”
ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শ্মিহাল জোর দিয়ে বলেছেন, “ইউক্রেন তার ভূগর্ভস্থ সম্পদ, অবকাঠামো এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে।” উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পূর্বে প্রদত্ত সামরিক সহায়তার বিনিময়ে ইউক্রেনের কাছ থেকে কোনো অর্থ আদায়ের শর্ত রাখা হয়নি। ডোনাল্ড ট্রাম্প এর আগে এমন দাবি জানালেও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই ধরনের শর্ত প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে, ভবিষ্যতে ইউক্রেনকে দেওয়া সম্ভাব্য সামরিক সহায়তাকে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করা হবে।
এই চুক্তির ফলে ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যোগদানের সম্ভাবনাও কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এছাড়া, এই চুক্তির মাধ্যমে ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি এখতিয়ারের অধীনে আনা হচ্ছে না। ভবিষ্যতে প্রকল্পগুলোতে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই অংশীদারিত্ব করতে ইউক্রেন বাধ্য থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো ন্যায্য শর্তে দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে।
মিলোওয়ানোভ আরও লিখেছেন, “ইউক্রেনকে সবকিছু যুক্তরাষ্ট্রকে বিক্রি করতে হবে, অথবা সমস্ত বিনিয়োগ একটি তহবিলের মাধ্যমে করতে হবে—এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বরং, এই চুক্তির মাধ্যমে ভবিষ্যতে প্রকল্পগুলোতে ন্যায্য বাজার সুবিধা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।”
জানা যায়, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির দল প্রথমে এই “বিরল মৃত্তিকা” চুক্তির ধারণা তৈরি করে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে এটি ছিল একটি “বিজয়ের পরিকল্পনা”। ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থন পাওয়ার আশায় মূলত এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। কারণ, বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনের প্রতি যে সমর্থন দেখাচ্ছিল, ট্রাম্প প্রশাসনের ক্ষেত্রে তেমনটা নাও হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
তবে, ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্টকে কিয়েভে পাঠানো হয় এবং একটি খসড়া চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়, যা দেখে মনে হয়েছিল যেন “ট্রেনে বসে লেখা হয়েছে”। এই চুক্তিতে ইউক্রেনকে নানা ধরনের শর্তে আবদ্ধ করার প্রস্তাব ছিল, বিনিময়ে কোনো নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ছিল না।
এরপর, চুক্তির শর্তাবলী সংশোধনের জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে, জেলেনস্কির ওয়াশিংটনে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরের কথা ছিল। কিন্তু, হোয়াইট হাউসে এক আলোচনার সময় মতবিরোধ দেখা দিলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে স্বাক্ষর ছাড়াই ফিরে আসতে হয়।
চুক্তিটি কার্যকর করতে ইউক্রেনের পার্লামেন্টের অনুমোদন প্রয়োজন। “কারিগরি চুক্তি” নিয়েও আলোচনা চলছে, যা চূড়ান্ত করা এখনো বাকি। ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধের কারণে এই চুক্তির ফলে তাৎক্ষণিক ভাবে বড় ধরনের কোনো চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে, জেলেনস্কি প্রশাসন আশা করছে, এই চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে কিয়েভের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভলোদিমির জেলেনস্কিকে শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে ভ্লাদিমির পুতিনের চেয়ে বেশি সমস্যা সৃষ্টিকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদিও তিনি ধীরে ধীরে রুশ নেতার সমালোচনা করতে শুরু করেছেন।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। সেক্রেটারি বেসেন্ট এটিকে “ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের সূচনা” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের প্রতি তার সমর্থন অব্যাহত রাখবে।
বেসেন্টের ভাষ্যমতে, “এই চুক্তি রাশিয়াকে স্পষ্টভাবে একটি বার্তা দেয় যে ট্রাম্প প্রশাসন দীর্ঘমেয়াদে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও সমৃদ্ধ ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে শান্তি প্রক্রিয়া চায়।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান