যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে, নারীরা আজ শুধু মা বা পরিবারের প্রধান নন, তারা সরাসরি দেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে শামিল হয়েছেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠিন লড়াইয়ে তারা এখন যোদ্ধা, ডাক্তার এবং অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর থেকে যুদ্ধের মোড় ঘোরানোর পেছনে নারীদের অবদান বাড়ছে, যা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
কিয়েভের রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং প্যারামেডিক হিসেবে কাজ করা কাতেরিনা জারেম্বো, যুদ্ধের শুরুতে একাডেমিক পেশা ছেড়ে দেন। তিনি ফ্রন্ট লাইনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করেন, এরপর দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে যোগ দেন ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীতে।
জারেম্বো মনে করেন, দেশের ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনীর হাতে, তাই পেশাদার হিসেবে কাজ করাটা জরুরি। তার মতে, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি ইউক্রেনের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে, যা স্বৈরাচারকে আরও উৎসাহিত করবে।
জারেম্বোর ‘হসপিটলার্স মেডিকেল ব্যাটালিয়ন’ আহত সৈন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয় এবং তাদের সরিয়ে নিতে সাহায্য করে। এই দলের বেশিরভাগ সদস্যই নারী।
বর্তমানে ইউক্রেনের প্রায় ৯ লাখ সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে ৭০,০০০ এর বেশি নারী সদস্য রয়েছেন। এদের মধ্যে ২০,০০০ এর বেশি সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ছেন এবং ৫,৫০০ জন সম্মুখ সারিতে অবস্থান করছেন।
ইউক্রেনের সংসদ সদস্য ইয়েভহেনিয়া ক্রাভচুক জানান, নারীদের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। সবাই বিভিন্ন কারণে স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছেন।
কারো পরিবারের সদস্য যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, তাই প্রতিশোধ নিতে এসেছেন। আবার কেউ এসেছেন দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে।
যুদ্ধ কিভাবে ইউক্রেনীয় সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলেছে, জারেম্বোর পরিবার তার জলন্ত উদাহরণ। তার স্বামী এখন সামরিক প্রযুক্তি সরবরাহকারী এবং তাদের সন্তানেরাও যুদ্ধের বিপদ সম্পর্কে অবগত।
জারেম্বো যখন আহত সৈন্যদের চিকিৎসা করেন, তখন তার ছোট শিশুরা তার কাছে এসে নিরাপত্তা খোঁজে।
লেসিয়া ওরোবেতসের স্বামী ফ্রন্ট লাইনে যুদ্ধ করছেন, ফলে পরিবারের প্রকৌশল ব্যবসা এখন তিনি একা সামলাচ্ছেন। কয়েক মাস আগে স্বামীর ছুটিতে আসার সময় তিনি তার দুই মেয়েকে ভবিষ্যতের পেশা সম্পর্কে আলোচনা করেন।
তাদের পরামর্শ ছিল, মেয়েদের একটি বেসামরিক পেশার পাশাপাশি সামরিক দক্ষতাও অর্জন করা উচিত। ওরোবেতস মনে করেন, সম্ভবত আগামী দশক হবে যুদ্ধের দশক, তাই নিজেদের রক্ষার জন্য প্রত্যেকেরই প্রস্তুত থাকা দরকার। তার দুই মেয়ে ছোটবেলা থেকেই বন্দুক চালানো শিখছে।
২০১৪ সালের আগে, নারীরা মূলত সমর্থনকারী ভূমিকায় ছিলেন। ক্রাভচুকের মতে, তখন নারীরা স্নাইপার বা গ্রেনেড লঞ্চার হিসেবে কাজ করতে চাইলেও তাদের রান্নাবান্না বা স্বাস্থ্য সেবার মতো কাজ করতে হতো। তবে তারা আসলে যুদ্ধক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতেন।
তাদের ‘অদৃশ্য ব্যাটালিয়ন’ বলা হতো। ২০১৭ সালে নারীদের জন্য সব ধরনের সামরিক পদে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা তাদের এতদিনকার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেয়।
যুদ্ধের আগে, ইউক্রেনের পার্লামেন্ট নারীদের জন্য সামরিক বাহিনীতে নাম লেখানো বাধ্যতামূলক করে। এর পরপরই হাজার হাজার নারী সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
বর্তমানে তারা স্নাইপার, ড্রোন অপারেটর, যুদ্ধবিমান চালক এবং গোলন্দাজ হিসেবে কাজ করছেন। এদের মধ্যে প্রায় ১,৫০০ জন পদক পেয়েছেন, আর ৫ জন সর্বোচ্চ ‘ইউক্রেনের বীর’ খেতাব অর্জন করেছেন।
গত ১৭ নভেম্বর, নাতালিয়া গ্রাবার্চুক নামক একজন নারী বিমান বিধ্বংসী গানার হিসেবে তার প্রথম দিনেই একটি রুশ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেন।
এছাড়াও, লেসিয়া ওরোবেতস ‘দ্য প্রাইস অফ ফ্রিডম’ নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করেছেন, যারা ইউক্রেন ও ইউরোপীয় বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘স্কাই শিল্ড’ তৈরির প্রস্তাব করেছেন।
ইউক্রেনের দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান ওলেনা ট্রেগুব বলেছেন, গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাখাতে নারীদের ভূমিকা বাড়ছে, তেমনিভাবে বাড়ছে সরকার পরিচালনায়ও তাদের অংশগ্রহণ। তিনি সরকারি বিভিন্ন স্বচ্ছতা বিষয়ক সংস্থার প্রধান হিসেবে নারীদের নাম উল্লেখ করেন।
এছাড়াও, নারীরা এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তার জন্য সোচ্চার হয়েছেন। ট্রেগুবের মতে, নারীদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকায় তারা সহজেই দেশ ত্যাগ করতে পারেন এবং আন্তর্জাতিক মহলে ইউক্রেনের পক্ষে সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
যুদ্ধকালীন সময়ে নারীরা অর্থনীতির চাকা সচল রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। ক্রাভচুক জানিয়েছেন, সরকার ট্রাক, ট্রাক্টর বা নির্মাণকাজের মতো বিভিন্ন পেশায় নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
গত বছর, ইউক্রেনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণের ৬১ শতাংশ এবং ব্যবসার ৫৯ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জারেম্বোর মতে, নারীদের এই অগ্রযাত্রা প্রমাণ করে যে, ইউক্রেন একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের শিশুদের রাশিয়াতে পাচার এবং নারীদের ওপর ধর্ষণ ও হত্যার মতো ঘটনার বিরুদ্ধে লড়ছেন।
তাদের এই লড়াই কেবল দেশের সীমান্ত রক্ষার জন্য নয়, বরং ইউক্রেনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা