জাতিসংঘের ৮০ বছরে মানবিকতায় সংকট: উদ্বাস্তু শিশুদের জীবনে চরম অনিশ্চয়তা!

জাতিসংঘের (United Nations – ইউএন) ৮০তম বর্ষপূর্তি: মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে অনিশ্চয়তা।

বিশ্বজুড়ে সংঘাত, দারিদ্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানবিক বিপর্যয় বাড়ছে, এমন এক পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের ত্রাণ কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে গভীর অনিশ্চয়তা। উন্নত দেশগুলো সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এই সংকট আরও তীব্র হচ্ছে।

জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি (World Food Programme – ডব্লিউএফপি) এবং উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থাগুলোর (UNHCR) তহবিল উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানবিক সহায়তার ভবিষ্যৎ এখন হুমকির মুখে।

কেনিয়ার কাকামা শরণার্থী শিবিরে (Kakuma Refugee Camp) আশ্রয় নেওয়া ৪১ বছর বয়সী অউজেন সিমানিম্পায়ে ২০০৭ সাল থেকে জাতিসংঘের সাহায্যেই তাঁর নয় সন্তানের ভরণপোষণ করছেন। যুদ্ধের কারণে কঙ্গো থেকে পালিয়ে আসা এই নারী বলেন, “আমরা তো দেশে ফিরতে পারি না, কারণ সেখানে এখনও মানুষ মারা যাচ্ছে।”

কাকামা শরণার্থী শিবিরে জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি এবং ইউএনএইচসিআর-এর সহায়তায় বর্তমানে তিন লক্ষাধিক শরণার্থীর জীবনধারণ চলছে।

কয়েক কিলোমিটার দূরে কালেরেবেই শরণার্থী শিবিরে (Kalobeyei Refugee Settlement) বসবাসকারী বাহাতি মুসাবা নামের আরেক কঙ্গোলীয় নারী জানান, ২০১৬ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা তাঁর সন্তানদের শিক্ষা, খাদ্য, জল এবং স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমানে নগদ অর্থ সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

জাতিসংঘের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর একটি হলো বর্তমানে দেখা দেওয়া এই তহবিল সংকট। জানা গেছে, জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় সাহায্যদাতা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ট্রাম্প প্রশাসনসহ পশ্চিমা দেশগুলো আন্তর্জাতিক সহায়তা হ্রাস করেছে।

কিছু দেশ তাদের সামরিক খাতে অর্থ ব্যয় করতে চাইছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাই এখন বাজেট কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে।

জাতিসংঘের সাবেক মানবিক সহায়তা প্রধান এবং বর্তমানে নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের প্রধান ইয়ান ইগেল্যান্ড বলেন, “মানবিক কর্মীদের জন্য এটি জাতিসংঘের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংকট। এর ফলে জরুরি প্রয়োজন এবং সহায়তা প্রদানের মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়বে।”

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এরই মধ্যে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের কর্মীদের সংখ্যা ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে জাতিসংঘের সাহায্য বিতরণের পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

মানবিক কর্মীরা প্রায়ই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাগুলোতে কাজ করেন। এমনকি নতুন ভাইরাস শনাক্ত করতে বা খরা কবলিত অঞ্চলে খাবার ও পানি পৌঁছে দিতে তাঁদের প্রায়ই দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজায় যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে ২০২৩ সাল ছিল মানবিক কর্মীদের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বছর।

জাতিসংঘের ত্রাণ কার্যক্রম বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। মিয়ানমার, সুদান, সিরিয়া এবং ভেনেজুয়েলার মতো বিভিন্ন দেশে অস্থিরতা থেকে পালিয়ে আসা মানুষজনদের আশ্রয়, খাদ্য ও পানি সরবরাহ করার পাশাপাশি পোলিও নির্মূলেও সংস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তবে অনেক সমালোচক মনে করেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাতিসংঘের কার্যক্রমগুলো অত্যন্ত জটিল ও আমলাতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি এবং উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থায় তাদের মোট বাজেটের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ দিত।

কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে বিদেশি সহায়তায় প্রায় ৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৬ লক্ষ ৫৪ হাজার কোটি টাকার বেশি) কাটছাঁট করার ফলে সংস্থাগুলো বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কর্মী ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর কার্ল স্কো বলেন, “বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৩৪ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে। চার বছর আগের তুলনায় এই সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। কিন্তু আমাদের তহবিলের পরিমাণ ৪০ শতাংশ কমে গেছে। ফলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।”

জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ (UNRWA) ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকে।

ইসরায়েল অভিযোগ করে, ইউএনআরডব্লিউএ-র স্কুলগুলোতে ইসরায়েল-বিরোধী মনোভাব তৈরি করা হয়। অন্যদিকে, ইউএনআরডব্লিউএ-র পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।

লেবাননের মার এলিয়াস শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ইসা হাজ হাসান বলেন, “ইউএনআরডব্লিউএ-র সাহায্য না পেলে আমরা হয়তো না খেয়ে মারা যেতাম। তারা আমাদের ঘর তৈরি করতে সাহায্য করেছে এবং স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছে। আমার সন্তানেরা তাদের স্কুলে পড়াশোনা করেছে।”

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে খাদ্য এবং ক্ষুধার চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু সেই অনুযায়ী সহায়তা মিলছে না।

জাতিসংঘের বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হলে সদস্য দেশগুলোর আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।

তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *