গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা: জাতিসংঘের চাঞ্চল্যকর রিপোর্টে তোলপাড়!

গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা চালাচ্ছে, জাতিসংঘের তদন্তে এমনটাই উঠে এসেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের (Human Rights Council) অধীনে গঠিত একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যার মতো অপরাধ করেছে। এটি জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আসা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রমাণ।

মঙ্গলবার প্রকাশিত ৭২ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে কমিশন উল্লেখ করেছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজায় চারটি ‘গণহত্যামূলক’ কাজ করেছে। এর মধ্যে ফিলিস্তিনিদের হত্যা, গুরুতর শারীরিক ও মানসিক আঘাত দেওয়া, তাদের জীবনযাত্রার পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করা যা তাদের শারীরিক ধ্বংস ডেকে আনবে এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৬৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। তবে মন্ত্রণালয় হতাহতের সংখ্যায় বেসামরিক ও যোদ্ধাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেনি।

ইসরায়েল সরকার শুরু থেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তারা দাবি করে আসছে, গাজায় তারা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করছে এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনেই সব কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনকে ‘বিকৃত ও মিথ্যা’ আখ্যা দিয়ে এই কমিশন বাতিলের দাবি জানিয়েছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই প্রতিবেদন হামাসের মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া, ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদকে ইসরায়েল-বিরোধী হিসেবে অভিযুক্ত করে আসছে।

তবে গণহত্যার অভিযোগ ক্রমশ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি, মার্কিন সিনেটর ক্রিস ভ্যান হোলেন এবং জেফ মারকলি বলেছেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ‘গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার পরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন করছে এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রও জড়িত।

এর আগে, আন্তর্জাতিক গণহত্যা বিশেষজ্ঞ সংস্থা (International Association of Genocide Scholars) ইসরায়েলকে গাজায় গণহত্যা চালানোর জন্য দায়ী করে। এমনকি, গত জুলাই মাসে ইসরায়েলের দুটি মানবাধিকার সংস্থাও প্রথমবার তাদের দেশের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যার অভিযোগ আনে। এছাড়া, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (International Court of Justice) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছিল।

জাতিসংঘের প্যানেলের এই প্রতিবেদন এমন এক সময়ে প্রকাশ হলো, যখন আন্তর্জাতিক নিন্দার মধ্যেই ইসরায়েল গাজা শহরে অভিযান শুরু করেছে। সোমবার নেতানিয়াহু স্বীকার করেছেন, তার দেশ ‘এক ধরনের একাকীত্বের’ শিকার হচ্ছে, যা হয়তো দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক, সাংবাদিক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং মানবিক সহায়তা কর্মীদের ওপর সরাসরি হামলা চালানো হয়েছে। এমনকি, নিরাপদ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত স্থানগুলোতেও তাদের হত্যা করা হয়েছে। কমিশন জানায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ৫ বছর বয়সী হিন্দ রাজাব ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার ঘটনাও এর প্রমাণ। ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার সময় তাদের ওপর গুলি চালায়, এমনকি তাদের মধ্যে শিশুদেরও হত্যা করা হয়।

কমিশন আরও উল্লেখ করেছে, ইসরায়েলি বাহিনী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য এমন অস্ত্র ব্যবহার করেছে, যা ব্যাপক সংখ্যক বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে।

প্রতিবেদনে ইসরায়েলের অবরোধের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ইসরায়েল গাজায় দীর্ঘ সময় ধরে অবরোধ করে রেখেছে, যার ফলে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে পানি, খাদ্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে।

এ বছর মার্চে ইসরায়েল গাজায় ১১ সপ্তাহের জন্য সব ধরনের সহায়তা বন্ধ করে দেয়। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে অবরোধ তুলে নেওয়ার পর, একটি নতুন মার্কিন-ইসরায়েলি গোষ্ঠী – গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন – ওই অঞ্চলের ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নেয়। এরপর ওই সংস্থা পরিচালিত স্থানগুলোতে ত্রাণ নিতে যাওয়া কয়েকশ ফিলিস্তিনি নিহত হয়। আগস্টে, জাতিসংঘের একটি প্যানেল গাজা শহর এবং আশেপাশের এলাকাকে দুর্ভিক্ষ কবলিত ঘোষণা করে এবং জানায় যে, প্রায় ৫ লাখের বেশি মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের সামান্য পরিমাণে ত্রাণ পাঠানোর সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার একটি কৌশল মাত্র, যা ফিলিস্তিনিদের ওপর ক্ষুধা ও অমানবিক জীবন চাপিয়ে দেওয়ার শামিল।

নেতানিয়াহু বারবার গাজায় দুর্ভিক্ষ হচ্ছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আগস্টের শুরুতে তিনি বলেছিলেন, ‘ইসরায়েলের দুর্ভিক্ষ তৈরির কোনো নীতি নেই। ইসরায়েলের নীতি হলো দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করা।’ তিনি আরও বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েল গাজায় ২০ লাখ টনের বেশি ত্রাণ পাঠিয়েছে।

প্রতিবেদনে ইসরায়েলের যুদ্ধ-লক্ষ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি শিশুদের ওপর ব্যাপক ও ইচ্ছাকৃত হামলা প্রমাণ করে যে, সামরিক অভিযানগুলো কেবল হামাসকে পরাজিত করার জন্য নয়, বরং ফিলিস্তিনি শিশুদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। গাজার শিশুরা মানসিক ও শারীরিক উভয় দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রতিবেদনে একজন ডাক্তারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘গাজায় শৈশব ধ্বংস হয়ে গেছে।’ এছাড়া, অপুষ্টির কারণে শিশুরা কথা বলতে এবং ভাষার স্বাভাবিক বিকাশ ঘটাতে পারছে না। এমনকি, তাদের দীর্ঘমেয়াদী জ্ঞানীয় সমস্যাও হতে পারে। কমিশন আরও জানায়, ইসরায়েল গাজায় শিশুদের জন্য ফর্মুলা ও বিশেষ দুধ সরবরাহ করতেও অস্বীকার করেছে, যার ফলে নবজাতক ও শিশুদের অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী ফিলিস্তিনিদের ওপর যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা চালিয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের যৌন সহিংসতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

প্রতিবেদনে নেতানিয়াহু, প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগ এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গণহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।

জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে গাজায় গণহত্যা প্রতিরোধে সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *