স্বাস্থ্য বিষয়ক নতুন একটি তথ্যচিত্র, “টক্সিক নেশন” সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে, যা আমাদের চারপাশে থাকা কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করছে। ছবিটিতে খাদ্য এবং পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত চারটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে: অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার (ultraprocessed foods), বীজ থেকে তৈরি তেল (seed oils), কীটনাশক ও আগাছানাশক (herbicides and pesticides), এবং পানিতে ফ্লুরাইড মেশানো (fluoride)। চলুন, এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক এবং দেখা যাক, বিশেষজ্ঞদের মতামত কী।
অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার: বর্তমান বিশ্বে, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে, অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা বাড়ছে। এই ধরনের খাবারে ফাইবার কম থাকে, কিন্তু ক্যালরি, চিনি, ফ্যাট এবং লবণের পরিমাণ বেশি থাকে। উদাহরণস্বরূপ, বাজারে সহজলভ্য চিপস, প্যাকেটজাত নুডলস, চিনিযুক্ত পানীয় এবং প্রক্রিয়াজাত স্ন্যাকস এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
উদ্বেগের বিষয় হলো, নিয়মিত এসব খাবার গ্রহণ করলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্থূলতা, ক্যান্সার, স্মৃতিভ্রংশ এবং ঘুমের সমস্যাসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবারের কারণে শরীরের বিপাক ক্রিয়ায় (metabolism) সমস্যা দেখা দিতে পারে। ফাইবারের অভাবে পরিশোধিত শর্করা শরীরে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই, স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের জন্য ফল, সবজি, শস্য, বাদাম এবং বীজ জাতীয় খাবার বেশি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
বীজ থেকে তৈরি তেল: হৃদরোগের কথা চিন্তা করে, অনেক বিশেষজ্ঞ প্রাণীজ ফ্যাট যেমন – গরুর মাংসের চর্বি, শুকরের চর্বি বা মাখনের পরিবর্তে উদ্ভিজ্জ তেল ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এই ধারণা থেকেই বীজ থেকে তৈরি তেলের ব্যবহার বাড়ে। ক্যানোলা তেল, যা সাধারণত “রাই” গাছের বীজ থেকে তৈরি হয়, ভুট্টা, সূর্যমুখী, এবং অন্যান্য বীজের তেল এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই ধরনের তেল তৈরির প্রক্রিয়া এবং এদের রাসায়নিক গঠনের কারণে কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে। উচ্চ তাপে রান্না করলে বা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করলে এই তেলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং শরীরের জন্য ক্ষতিকর কিছু উপাদান তৈরি করতে পারে।
তবে, অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্ভিজ্জ তেল সমৃদ্ধ খাবার, প্রাণীজ ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবারের চেয়ে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তারপরও, রান্নার জন্য অতিরিক্ত ব্যবহারের পরিবর্তে জলপাই তেল বা অ্যাভোকাডো তেলের মতো স্বাস্থ্যকর বিকল্প ব্যবহার করা যেতে পারে।
কীটনাশক ও আগাছানাশক: কৃষিকাজে ব্যবহৃত কীটনাশক ও আগাছানাশক নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে গ্লাইফোসেট নামক একটি আগাছানাশক ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া, এটি এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের (endrocrine system) ক্ষতি করতে পারে এবং অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার (gut microbiome) উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।
এর ফলে, আমাদের শরীরে হজমসংক্রান্ত সমস্যা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে।
যদিও খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসন (Food and Drug Administration – FDA) নিশ্চিত করতে চেষ্টা করে যে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ যেন নিরাপদ মাত্রায় থাকে, তারপরও খাদ্য তালিকায় কীটনাশকের পরিমাণ কমাতে জৈব খাবার (organic food) খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
বাজারে সহজলভ্য না হলে, কীটনাশকযুক্ত খাবারগুলো ভালোভাবে ধুয়ে খাওয়ার কথা বলা হয়।
ফ্লুরাইড: আমাদের দেশে পানির সঙ্গে ফ্লুরাইড মেশানো হয়, যা দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু “টক্সিক নেশন” তথ্যচিত্রে দাবি করা হয়েছে, এই ফ্লুরাইড টুথপেস্টে ব্যবহৃত সোডিয়াম ফ্লুরাইড থেকে ভিন্ন। তাদের মতে, এটি ফসফেট সার তৈরির একটি উপজাত, যা আর্সেনিকের মতো ভারী ধাতু ধারণ করে।
অতিরিক্ত ফ্লুরাইড গ্রহণের ফলে শিশুদের দাঁতের এনামেলের ক্ষতি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানিতে ফ্লুরাইড মেশানো এখনো দাঁতের ক্ষয় কমাতে কার্যকরী। তবে, যারা ফ্লুরাইড এড়িয়ে চলতে চান, তারা ফ্লুরাইড ফিল্টার ব্যবহার করতে পারেন। দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করা, চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় সীমিত করা এবং ডেন্টিস্টের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
সবশেষে, “টক্সিক নেশন” তথ্যচিত্রটি স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন উদ্বেগের বিষয়গুলো সামনে এনেছে। তবে, প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের ভিন্নমত রয়েছে। তাই, স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে এবং বিভিন্ন তথ্যের সঠিকতা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন