মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছে, যার ফলস্বরূপ বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে তারা যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, তার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপীয় পণ্য বেশি বিক্রি হয়।
এই বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ট্রাম্প প্রশাসন ইইউ-এর উপর চাপ সৃষ্টি করছে। এর প্রতিক্রিয়ায়, ইইউ-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে তারা ডিজিটাল পরিষেবা সহ বিভিন্ন খাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে এনেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের মূল কারণ বাণিজ্য ঘাটতি হলেও, এর পেছনে আরও কিছু বিষয় জড়িত রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প ইইউ-কে পছন্দ করেন না এবং জার্মানির প্রতিও তার বিরূপ ধারণা রয়েছে। এই কারণে তিনি ইইউ-এর উপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চাপ সৃষ্টি করেন।
যুক্তরাষ্ট্র কী চাইছে?
যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের কাছ থেকে বেশি পণ্য কিনুক। বিশেষ করে, তারা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনার উপর জোর দিচ্ছে।
এর মাধ্যমে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস ব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিবর্তন তাৎক্ষণিকভাবে ফলপ্রসূ নাও হতে পারে।
এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোকে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা মার্কিন প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বেশি পরিমাণে কেনে।
তবে, ইইউ-এর দেশগুলো সম্ভবত তাদের নিজস্ব উৎপাদিত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনতে বেশি আগ্রহী হবে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমদানি করা গাড়ির উপর আরোপিত ১০ শতাংশ শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। বিশ্লেষকদের মতে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি প্রতীকী বিজয় হতে পারে।
খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের খাদ্য ও কৃষি পণ্যের বিধিনিষেধ নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছে। বিশেষ করে, হরমোন ব্যবহার করে উৎপাদিত গরুর মাংস এবং ক্লোরিন দিয়ে পরিষ্কার করা মুরগির মাংসের উপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তাদের আপত্তি রয়েছে।
তবে, ইইউ এই বিষয়ে কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়।
মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) নিয়েও ট্রাম্পের অসন্তোষ রয়েছে। তিনি মনে করেন, এই কর মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য একটি বোঝা।
যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভ্যাট একটি বাণিজ্য নিরপেক্ষ কর, যা আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য।
আলোচনার কৌশল
ট্রাম্পের আলোচনা কৌশল হলো, প্রথমে উচ্চ হারে শুল্কের হুমকি দেওয়া এবং পরে কম হারে একটি চুক্তিতে আসা। ইইউ-এর উপর তিনি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন, যা বাণিজ্য যুদ্ধকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
যদি এই শুল্ক সত্যিই আরোপ করা হয়, তবে তা ইউরোজোনের অর্থনীতির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতি ১ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে বিনিয়োগ ৬ শতাংশের বেশি হ্রাস পেতে পারে।
ইইউ এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘শূন্য থেকে শূন্য’ (zero for zero) চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে, যার মাধ্যমে উভয় পক্ষের শিল্প পণ্যের শুল্ক সম্পূর্ণভাবে তুলে দেওয়া হবে।
তবে, ট্রাম্প এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের এই ধরনের কৌশল ব্যবসার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা তৈরি করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
বাংলাদেশের উপর প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ-এর মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব বাংলাদেশে নাও পড়তে পারে, তবে এর কিছু পরোক্ষ প্রভাব অবশ্যই থাকবে।
উভয় অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্য কমে গেলে, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়তে পারে, যা বাংলাদেশের আমদানি খরচ বাড়িয়ে দেবে।
এছাড়া, বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হলে, বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।
তাই, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের এই পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং দেশের অর্থনীতির সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
তথ্য সূত্র: Associated Press