মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য হ্রাসের ফলে আফ্রিকার দেশগুলোতে ম্যালেরিয়া নির্মূলের দশক-ব্যাপী অগ্রগতি হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই রোগের বিস্তার বাড়ছে, যা জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সম্প্রতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচিতে কাটছাঁট করার সিদ্ধান্তের কারণে এমন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের (ডিআরসি) গোমা শহরের বাসিন্দা মায়ুমা ইদি ফেজা নামের এক মা তাঁর অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসার জন্য অর্থ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাঁর এক বছর বয়সী ছেলের ম্যালেরিয়া হয়েছে এবং তিনি নিজেও এই রোগের শিকার। ফেজা বলেন, “আমার ছেলে এক সপ্তাহ ধরে অসুস্থ। আমারও শরীর ঠান্ডা লাগছে এবং মুখে তেতো স্বাদ।” কাজ না থাকায়, তিনি খাবার জোগাড় করতেই যেখানে কষ্ট পাচ্ছেন, সেখানে সন্তানের চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য তাঁর নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) তথ্য অনুযায়ী, ম্যালেরিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য ও নিরাময়যোগ্য রোগ। কিন্তু প্রতি বছর এই রোগে বিশ্বে কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু এবং গর্ভবতী মহিলারা এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিতে বেশি থাকে। ডিআরসিতে ম্যালেরিয়া একটি প্রধান ঘাতক ব্যাধি। নাইজেরিয়ার পরেই এই দেশটির অবস্থান। ২০২২ সালে, শুধুমাত্র ডিআরসিতে প্রায় ২৪,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যাদের অর্ধেকের বেশি ছিল পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় বৃহত্তম সাহায্যকারী দেশ। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বৈদেশিক সাহায্য হ্রাস করতে শুরু করে। এর ফলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি)-এর ম্যালেরিয়া প্রোগ্রামের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের প্রায় ৩৬ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে। এই অর্থ মূলত আফ্রিকার দেশগুলোতে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত হত। এর মধ্যে ছিল ম্যালেরিয়ার ওষুধ সরবরাহ এবং মশা তাড়ানোর জন্য কীটনাশকযুক্ত মশারি বিতরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি।
ডিআরসির ন্যাশনাল ম্যালেরিয়া কন্ট্রোল প্রোগ্রামের (পিএনএলপি) সাবেক মুখপাত্র মিশেল ইতাবু বলেন, এই সাহায্য হ্রাসের কারণে তাঁর দেশের স্বাস্থ্যখাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে, গর্ভবতী মহিলাদের জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের কারণে স্বল্প মেয়াদে অনেক মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে। দীর্ঘ মেয়াদে, ম্যালেরিয়া নির্মূলে আমেরিকার এতদিনের অর্জিত অগ্রগতিও নষ্ট হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাবেক ইউএসএআইডি কর্মী আন্নে লিন বলেন, “যখন হঠাৎ করে সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়, তখন সরকারের প্রতি অন্য সরকারগুলোর এবং দেশের নিজস্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমে যায়।”
মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল ম্যালেরিয়া কন্ট্রোল ম্যানেজার লুম্বানি মুন্থালি জানান, সম্প্রতি বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে তাঁর দেশে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ বেড়েছে। ইউএসএআইডি-এর সাহায্য কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
মালয়েশিয়ায় গত বছর ২,০০০ এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। মুন্থালি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তার কারণে মালয়েশিয়া ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।”
নাইজেরিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী পাতে জানান, তাঁরা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে স্বাস্থ্যখাতে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি পার্লামেন্ট এই খাতে অতিরিক্ত ২০০ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন করেছে। তিনি আরও বলেন, “মার্কিন সরকারের নীতির পরিবর্তনের ফলে নাইজেরিয়ার জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব এখন নাইজেরিয়া সরকারের।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র ম্যালেরিয়া নয়, অপুষ্টির শিকার শিশুদের অন্যান্য রোগ যেমন—হাম, কলেরা এবং ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিও বাড়ে। দরিদ্র দেশগুলোতে অপুষ্টি এবং ম্যালেরিয়া—এই দুটি বিষয় একটি চক্রের মতো কাজ করে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন