মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে শান্তি আলোচনার অগ্রগতি দেখতে না পায়, তাহলে কয়েক দিনের মধ্যেই তারা এই প্রচেষ্টা থেকে সরে আসতে পারে। এমনটাই জানিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। একইসাথে, ইউক্রেন একটি বিতর্কিত খনিজ চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে।
প্যারিসে ইউরোপীয় এবং ইউক্রেনীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর রুবিও শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো একটি চুক্তিতে আগ্রহী। তবে তিনি আরও যোগ করেন যে, বিশ্বজুড়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের আরও অনেক অগ্রাধিকার রয়েছে এবং অগ্রগতি না হলে তিনি আলোচনা থেকে সরে যেতে প্রস্তুত।
মার্কিন সিনেটর রুবিওর এই মন্তব্য হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে যুদ্ধ বন্ধের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা থেকে সরে আসার সবচেয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত। গত মাসে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাবের ভিত্তিতে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে বিনা শর্তে রাজি হয়েছিল। তবে ক্রেমলিন সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এর পরিবর্তে, তারা ৬০০ মাইলের ফ্রন্টলাইন জুড়ে নতুন করে সামরিক অভিযান শুরু করেছে এবং ইউক্রেনীয় বেসামরিক নাগরিক ও অবকাঠামোর ওপর বিমান হামলা জোরদার করেছে। এর ফলশ্রুতিতে, রবিবার সুমি শহরে বোমা হামলায় ৩৫ জন নিহত এবং ১১৭ জন আহত হয়েছে।
ট্রাম্প জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ফেরার পর ইউক্রেনের ওপর চাপ বাড়িয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানও সীমিত করেছেন। এমনকি তিনি সম্প্রতি ভলোদিমির জেলেনস্কি ও জো বাইডেনকে এই যুদ্ধের জন্য দায়ী করেছেন। যদিও ট্রাম্প ভ্লাদিমির পুতিনের সমালোচনা করতে এবং মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে রাজি হননি।
অন্যদিকে, খনিজ চুক্তি নিয়ে বিস্তারিত এখনো স্পষ্ট নয়। কিয়েভ হোয়াইট হাউসের এই দাবি মেনে নিয়েছে কিনা যে, তারা আগের সামরিক সহায়তার খরচ ‘পরিশোধ’ করবে, তা এখনো অজানা। ফেব্রুয়ারিতে জেলেনস্কি একটি বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের কাঠামোগত চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত ছিলেন। তবে ট্রাম্প এবং মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে তার একটি অপ্রত্যাশিত বৈঠকের পর সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
এরপর থেকে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। ইউক্রেনের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া স্বাইরিডেনকো জানিয়েছেন, একটি সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর ফলে ইউক্রেনের পুনর্গঠনের জন্য একটি বিনিয়োগ তহবিল গঠনের পথ সুগম হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের আমেরিকান অংশীদারদের সঙ্গে এই চুক্তি স্বাক্ষর করতে পেরে আনন্দিত।’ হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প জানান, আগামী বৃহস্পতিবার এই চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে।
মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট যোগ করেন, ‘আমরা এখনো বিস্তারিত নিয়ে কাজ করছি।’ তিনি জানান, সর্বশেষ খসড়াটি ৮০ পৃষ্ঠার এবং এটি আগের চুক্তির ‘প্রায় কাছাকাছি’। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সেটিই স্বাক্ষর করতে যাচ্ছি।’
গার্ডিয়ানে দেখা সর্বশেষ খসড়া অনুযায়ী, ইউক্রেন রাশিয়ার ২০২২ সালের আক্রমণের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া ‘উল্লেখযোগ্য বস্তুগত ও আর্থিক সহায়তার’ স্বীকৃতি দিয়েছে। সেইসাথে উভয় দেশের ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তি’ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শমিহাল আগামী সপ্তাহে ওয়াশিংটনে বেসেন্টের সঙ্গে চূড়ান্ত ‘কারিগরি আলোচনা’ করবেন। এই আলোচনায় ‘পুনর্গঠন বিনিয়োগ তহবিল’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে।
ইউক্রেনের পার্লামেন্টকে এই চুক্তি অনুমোদন করতে হবে বলে শুক্রবার জানিয়েছেন দেশটির উপ-অর্থনীতি মন্ত্রী। জেলেনস্কি ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে আগ্রহী। একই সময়ে, তিনি হোয়াইট হাউসের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, নতুন যৌথ তহবিল থেকে আসা রাজস্ব বাইডেন প্রশাসনের দেওয়া অস্ত্রের খরচ মেটাতে ব্যবহার করতে হবে।
ট্রাম্প আগে বলেছিলেন, ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৩০০ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩৩,০০০ বিলিয়ন টাকা) ‘ঋণী’। জেলেনস্কি উল্লেখ করেছেন যে, এই সহায়তা ঋণ হিসেবে নয়, অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়েছিল, যা রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলের সমর্থন নিয়ে কংগ্রেসে অনুমোদিত হয়েছিল। তাঁর মতে, ভবিষ্যতের যেকোনো অংশীদারিত্ব ‘সমতা’র ভিত্তিতে হতে হবে এবং উভয় দেশেরই এতে লাভবান হওয়া উচিত।
এই চুক্তিটি সম্ভবত মার্কিন অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের জন্য সহায়ক হবে, যারা চীনের কাছ থেকে আমদানি করা বিরল-ভূমি খনিজ পদার্থের ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে। ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় বেইজিং তাদের রপ্তানি সীমিত করেছে।
কিয়েভের সেন্টার ফর ইকোনমিক স্ট্র্যাটেজি থিংক ট্যাঙ্কের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ভলোদিমির লান্ডা বলেন, এই চুক্তি ‘বহুবার’ সংশোধন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘ভিতরে আসলে কী আছে, তা বলা কঠিন।’ লান্ডা মনে করেন, কিয়েভ সম্ভবত আগের ‘অফেরতযোগ্য সামরিক সাহায্যকে’ এখন ‘ঋণ’ হিসেবে মেনে নেবে না।
তিনি আরও যোগ করেন, ‘যদি হঠাৎ করে দেখা যায় যে, দেশ ও সংস্থাগুলো আগের বছরগুলোতে বিনা শর্তে দেওয়া সাহায্যের জন্য অর্থ চাইছে, তাহলে এটি গ্রহীতাদের আরও সতর্ক করে তুলবে এবং বিশ্বজুড়ে আগের দশকগুলোর কঠিন বিষয়গুলো পুনরায় খুলতে পারে।’
আলোচনা যখন চলছে, তখন রাশিয়া ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বে খারকিভ শহরের আবাসিক এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এতে একজন নিহত এবং কমপক্ষে ৭৪ জন আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে পাঁচজন শিশু। খারকিভের মেয়র ইগর তেরেকভ জানিয়েছেন, রাশিয়ান বাহিনী ক্লাস্টার munition সহ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এতে কমপক্ষে ২০টি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন, ৩০টি বাড়ি এবং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান