যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি: বাংলাদেশের বাণিজ্য খাতের জন্য শঙ্কার মেঘ?
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতি বিশ্ব বাণিজ্যকে নতুন পথে চালিত করছে। এই নীতির ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য আমদানির ওপর শুল্কের হার বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এর সরাসরি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে। বিশেষ করে, এই শুল্ক নীতির কারণে বাংলাদেশের বাণিজ্য খাতেও দেখা দিয়েছে উদ্বেগের ছায়া।
নতুন এই শুল্ক নীতি অনুযায়ী, প্রায় ৬৬টি দেশ এবং তাইওয়ান ও ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের ওপর বিভিন্ন হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু দেশের সঙ্গে আলোচনা করে শুল্কের হার কিছুটা কমানো হলেও, চীন ও ভারতের মতো বড় অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট চুক্তি হয়নি।
ফলে, তাদের উপর উচ্চ হারে শুল্ক বহাল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই শুল্ক নীতির কারণে রপ্তানিকারকদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক কোম্পানি জানিয়েছে, শুল্ক বাড়ার কারণে তাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে এবং লোকসান গুনতে হচ্ছে।
যদিও প্রথম দিকে বিশ্ব বাজারের প্রতিক্রিয়া তেমন জোরালো ছিল না, তবে বাণিজ্য বিশ্লেষকরা এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করছেন। তাদের মতে, এই নীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি একটি উদ্বেগের কারণ।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশাধিকার ধরে রাখতে অনেক দেশ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। যুক্তরাজ্য ১০%, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান ১৫% হারে শুল্ক দিতে রাজি হয়েছে।
যদিও এই হার গত বছরের তুলনায় বেশি, তবে ট্রাম্প প্রথমে যে শুল্কের ঘোষণা করেছিলেন, তার চেয়ে কম। আফ্রিকার দেশগুলো এবং এশিয়ার অনেক দেশ তুলনামূলকভাবে কম শুল্কের সম্মুখীন হচ্ছে।
থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো প্রায় ২০% শুল্কের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তাদের পণ্য রপ্তানি করতে পারবে।
ইন্দোনেশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের ১৯% শুল্ক হারের চুক্তি অন্যান্য দেশের রপ্তানিকারকদের চেয়ে তাদের কিছুটা সুবিধা দেবে। কারণ, তাদের প্রতিযোগী দেশগুলো, যেমন— ভিয়েতনাম, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও চীনের ওপর বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, চীন ও ভারতের জন্য পরিস্থিতি এখনো স্পষ্ট নয়। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করার জন্য সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়টি এখনো বিবেচনাধীন।
শুল্ক আরোপের কারণে চীনের ছোট কারখানাগুলোতে ক্ষতি হয়েছে এবং অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।
ভারতে রাশিয়ার থেকে তেল আমদানির ওপর অতিরিক্ত ২৫% শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, ফলে দেশটির মোট শুল্কের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০%।
ভারতের রপ্তানিকারকদের সংগঠন জানিয়েছে, এই শুল্কের কারণে আমেরিকার বাজারে তাদের প্রায় ৫৫% পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অনেক পুরোনো ক্লায়েন্ট হারাতে হতে পারে।
বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরাও এই শুল্ক নীতির কারণে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, জাপানে কারখানার উৎপাদন কমেছে এবং কর্মী নিয়োগও হ্রাস পেয়েছে।
এমনকি, হন্ডা মোটর ও টয়োটার মতো বড় কোম্পানিগুলোও শুল্কের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক নীতি শুধু বাণিজ্যিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করছে না, বরং এর ফলে অনেক দেশের অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যেমন— লাওস, মিয়ানমার ও সিরিয়ার মতো দেশগুলো ৪০-৪১% পর্যন্ত শুল্কের সম্মুখীন হচ্ছে।
কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাণিজ্য চুক্তি (USMCA) রয়েছে, যার ফলে তারা শুল্কের প্রভাব থেকে কিছুটা রেহাই পেয়েছে। তবে, মেক্সিকোর কিছু পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক ধার্য করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কিভাবে এই নতুন শুল্ক নীতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়া যায়।
আমাদের রপ্তানি খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে নতুন বাজার খুঁজতে হবে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য কৌশল তৈরি করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, পাট ও অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের ওপর এই শুল্ক নীতির প্রভাব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলো পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণের চেষ্টা করছে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস