শুষ্ক শীতের পর: আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে দাবানলের ঝুঁকি বাড়ছে
শীতকাল প্রায় চলে গেলেও অনেক স্থানে বৃষ্টির দেখা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল থেকে শুরু করে মিনেসোটা, আইওয়া এমনকি নিউ জার্সির কিছু অংশেও শীত যেন আসেইনি।
অনেক জায়গায় রেকর্ড পরিমাণ শুষ্ক শীত অতিবাহিত হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে তো বরফের দেখা পাওয়া যায়নি বললেই চলে। যার ফলস্বরূপ সেখানকার গাছপালাগুলো শুকনো হয়ে আছে। আর এমন পরিস্থিতিতে দাবানলের ঝুঁকি বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে গরম ও শুষ্ক আবহাওয়ার কথা বলা হয়েছে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে। ফলে সেখানকার অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা আসন্ন দাবানল মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অ্যারিজোনায় সম্প্রতি এক প্রশিক্ষণ শিবিরে এক হাজারের বেশি অগ্নিনির্বাপক কর্মী ও ব্যবস্থাপক অংশ নিয়েছিলেন, যেখানে বিমান থেকে শুরু করে গাছ কাটার করাত এবং ফায়ার লাইন তৈরি করা সহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
আবহাওয়ার এই শুষ্ক পরিস্থিতি এবং উষ্ণ তাপমাত্রা একসাথে মিলিত হয়ে আগুনের বিস্তার ও তীব্রতা আরও বাড়িয়ে তোলে। অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের বন ও অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তার রাজ্যে বেশ কয়েক মাস ধরেই এমন অবস্থা বিরাজ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার্স ফর এনভায়রনমেন্টাল ইনফরমেশন-এর বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের শুরু থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৬ ইঞ্চির সামান্য কম, যা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ১ ইঞ্চি কম। আবহাওয়াবিদরা এই সময়কে শীতকাল হিসেবে বিবেচনা করেন এবং সেই হিসাবে এটি ছিল রেকর্ড করা তৃতীয় শুষ্কতম শীতকাল।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের দক্ষিণে পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত ফ্ল্যাগস্টাফ শহরটি শীতকালে বরফের জন্য পরিচিত। সেখানকার বাসিন্দারা প্রায়ই এখানে এসে বরফ উপভোগ করেন। কিন্তু এবার শীতকালে শহরটিতে প্রায় ৫০ ইঞ্চি কম বরফ পড়েছে। যদিও মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে এখানে একটি বড় ঝড় হয়, যার ফলে আন্তঃরাজ্য ৪০ মহাসড়ক বন্ধ করে দিতে হয় এবং অনেক যাত্রী আটকা পড়েন, তবে এতেও এই ঘাটতি পূরণ হয়নি।
অন্যদিকে, নিউ মেক্সিকোতে অন্তত ১৭টি স্থানে রেকর্ড পরিমাণ শুষ্ক শীত দেখা গেছে। আলবুকের্কিতে তিন মাসে মাত্র ০.১২ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা একটি নতুন সর্বনিম্ন রেকর্ড। সেখানকার ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিসের এক ঊর্ধ্বতন আবহাওয়াবিদ জানিয়েছেন, যেন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে এবং খরা পরিস্থিতি চলছে।
এই পরিস্থিতিতে দাবানলের ঝুঁকি কেমন হতে পারে? আবহাওয়াবিদরা বলছেন, পরিস্থিতি ভালো না। এর কারণ হলো, শুষ্ক আবহাওয়া এবং উষ্ণ বাতাসের কারণে ইতিমধ্যে অ্যারিজোনা, নিউ মেক্সিকো এবং মধ্য-পশ্চিমের কিছু অংশে দাবানলের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে ওклаহোমায় এমন সতর্কতা দেখা গিয়েছিল, যেখানে আগুনে কয়েকশ’ বাড়ি পুড়ে যায়। এছাড়াও, নিউ জার্সি এবং ক্যারোলিনাতেও শুকনো পরিস্থিতির মধ্যে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
পশ্চিম অঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপক ও অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা উদ্বিগ্ন যে, অনেক পাহাড়ি অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে বরফ না থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। সাধারণত ১লা এপ্রিলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরফ জমে থাকে, কিন্তু আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, অনেক অঞ্চলে ইতোমধ্যে বরফ গলতে শুরু করেছে। এছাড়াও, বসন্তের শক্তিশালী বাতাস সেখানকার বরফের ওপর ধুলো জমা করে, যা গলন প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করে।
এমনকি আলাস্কার দক্ষিণাঞ্চলেও কম উচ্চতায় তুষারপাতের অভাব দেখা যাচ্ছে। ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেটেড ড্র্রট ইনফরমেশন সিস্টেমের তথ্য অনুযায়ী, অ্যাঙ্করেজ বিমানবন্দরে রেকর্ড পরিমাণ শুষ্ক ফেব্রুয়ারি মাস অতিবাহিত হয়েছে। মার্চ মাসের শুরুতে দক্ষিণ-পশ্চিম আলাস্কা এবং দক্ষিণ-মধ্য অঞ্চলের কিছু অংশে প্রায় কোনো তুষার ছিল না।
ক্যালিফোর্নিয়ায় সম্প্রতি কিছু বৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে সেখানকার তুষারপাতের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে এবং তা প্রায় স্বাভাবিকের কাছাকাছি পৌঁছেছে। তবে রাজ্যের দক্ষিণ অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা এখনো মাঝারি থেকে চরম খরা পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।
আগামী মঙ্গলবার নতুন দাবানল পরিস্থিতি নিয়ে পূর্বাভাস দেওয়া হবে। যদিও ক্যালিফোর্নিয়া বর্তমানে বড় ধরনের দাবানলের ঝুঁকিতে নেই, তবুও জানুয়ারিতে হওয়া ভয়াবহ আগুনে শহর এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসন কী পদক্ষেপ নিচ্ছে? চলতি বছর লস অ্যাঞ্জেলেসে আগুন লাগার পর পশ্চিমাঞ্চলের পৌর কর্তৃপক্ষ সচেতনতা বাড়াতে কমিউনিটি মিটিংয়ের আয়োজন করেছে, যার মধ্যে নিউ মেক্সিকোর সান জুয়ান কাউন্টিও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা, নিউ মেক্সিকো, কলোরাডো এবং উটাহ-এর সংযোগস্থল ‘ফোর কর্নার্স’ অঞ্চলে খারাপ পরিস্থিতির কারণে আগুন লাগার সম্ভাবনা রয়েছে। সান জুয়ান কাউন্টির মুখপাত্র জানিয়েছেন, মার্চ মাসের প্রথম ২৭ দিনে সেখানকার অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা ২৫টি ঝোপঝাড়ে লাগা আগুন এবং শুক্রবার আরও দুটি আগুনের ঘটনার মোকাবেলা করেছেন।
অ্যারিজোনায় ফিনিক্স ফায়ার ডিপার্টমেন্ট সেখানকার মেয়র এবং সিটি কাউন্সিলরদের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেছে। এছাড়াও, তারা আগুন লাগার আগেই তা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। প্রতিবেশী স্কটসডেল শহরে মেয়র লিসা বোরোস্কি দাবানল প্রতিরোধের জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন। এছাড়া, ফায়ার ডিপার্টমেন্টের কর্মীরা রাস্তাঘাটের পাশে ঝোপঝাড় ও আগাছা পরিষ্কারের কাজ করছে।
অ্যারিজোনা ফরেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের একজন ক্যাপ্টেন জানিয়েছেন, অনেকে দাবানলকে একটি বৃহত্তর সমস্যা হিসেবে দেখেন, যা তাদের শহরতলির বাইরের বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। তবে তার মতে, মানুষকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রস্তুতি নিতে হবে, এবং নিজের বাড়িকে রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস