ভারতে আসছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বাণিজ্য ও ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক!

যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরি ডি. ভেন্স ভারত সফরে আসছেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। আগামী সোমবার থেকে শুরু হতে যাওয়া এই চার দিনের সফরে অর্থনৈতিক, বাণিজ্য এবং ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

জানা গেছে, এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছে ট্রাম্প প্রশাসন। কারণ, এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ আরও তীব্র হচ্ছে, যেখানে নয়াদিল্লি হলো বেইজিংয়ের প্রধান প্রতিপক্ষ। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি হলে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে, যা পরবর্তীতে কূটনৈতিক সম্পর্ককেও সুদৃঢ় করতে সহায়তা করবে।

বর্তমানে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। সম্প্রতি পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভাইস প্রেসিডেন্ট ভেন্সের এই সফরকালে দুই পক্ষই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রগতির বিষয়ে পর্যালোচনা করবে এবং পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আলোচনায় বাণিজ্য চুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে। এর আগে, জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক (Director of National Intelligence) টুলসি গাবার্ড একটি ভূ-রাজনৈতিক সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে এসেছিলেন। এছাড়া, মোদি ও ট্রাম্পের মধ্যে এর আগে ওয়াশিংটনে বৈঠক হয়। মোদি, ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সফর করা প্রথম নেতাদের মধ্যে ছিলেন। সেই সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘মেগা পার্টনারশিপের’ ঘোষণা করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্ক কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করেন।

যদিও, ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের উপর ২৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল, যা ভারতীয় রপ্তানিকারকদের জন্য সাময়িক স্বস্তি এনেছিল। মোদি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যগুলোর উপর আরও শুল্ক কমানো, ভারতে বসবাস করা অনিবন্ধিত ভারতীয় নাগরিকদের ফেরত পাঠানো এবং সামরিক সরঞ্জাম কেনার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। উভয় দেশই একটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আলোচনা শুরু করতে রাজি হয়েছে।

এছাড়াও, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং স্পেসএক্সের সিইও, ইলন মাস্কের মধ্যে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারত প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন খাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারিত্ব আরও এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান, যা বাণিজ্য, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (Foreign Direct Investment), প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র হিসেবে কাজ করে। ভারত ‘কোয়াড’-এরও অংশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া অন্তর্ভুক্ত এবং এটি এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে।

অ্যাপল ইনকর্পোরেটেড (Apple Inc.) এবং গুগল-এর মতো শীর্ষস্থানীয় মার্কিন কোম্পানিগুলো সম্প্রতি ভারতে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছে। মাস্কের স্টারলিঙ্কও (Starlink) স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানের জন্য ভারতের শীর্ষস্থানীয় দুটি টেলিকম অপারেটরের সঙ্গে চুক্তি করেছে।

বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও জোরদার করতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যা প্রস্তাবিত বাণিজ্য চুক্তির অধীনে আসবে। ভারতের জন্য এই আলোচনাগুলো অত্যন্ত জরুরি, কারণ ট্রাম্পের সম্ভাব্য শুল্ক আরোপের কারণে দেশটির কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রাংশ, উচ্চ-প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং গহনার মতো খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মোদি ও ট্রাম্পের মধ্যে একটি ভালো সম্পর্ক রয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নির্ভরযোগ্য বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে বেইজিংকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন, তখন এই সম্পর্ক দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা আরও বাড়াতে সাহায্য করবে। ভারতও ইতোমধ্যেই ট্রাম্পকে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি তেল, জ্বালানি এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, যেমন অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা করছে।

তবে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতে তাদের কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের জন্য বৃহত্তর বাজার সুবিধা চাইছে, কিন্তু ভারতের কৃষি খাত দেশটির বিপুল সংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থান করে থাকে বলে নয়াদিল্লি এক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।

ভাইস প্রেসিডেন্ট ভেন্সের ভারত সফরটি তার পরিবারের জন্যও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, তার স্ত্রী উশা ভেন্স, যিনি একজন হিন্দু এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ভাইস প্রেসিডেন্ট তার স্মৃতিকথায় উশাকে ‘ভারতীয় অভিবাসীদের অত্যন্ত মেধাবী কন্যা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। জানা গেছে, উশার বাবা-মা ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।

ভাইস প্রেসিডেন্ট ভেন্সের সঙ্গে এই সফরে উশা, তাদের সন্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও থাকবেন। তারা জয়পুর ও আগ্রা শহর পরিদর্শন করবেন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *