শতবর্ষী ঐতিহ্য, আদিবাসীদের জিনিস! ফেরত চায় কানাডার আদিবাসী নেতারা

কানাডার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মূল্যবান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ভ্যাটিকানের হেফাজতে রয়েছে। এবার সেই নিদর্শনগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সরব হয়েছেন আদিবাসী নেতারা।

তাদের দাবি, এই সম্পদগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের, তাই অবিলম্বে তা ফেরত দেওয়া হোক।

ভ্যাটিকান সিটির অভ্যন্তরে, পোপের বাসভবনে, আদিবাসী সম্প্রদায়ের হাজারো মূল্যবান শিল্পকর্ম সংরক্ষিত আছে। এদের মধ্যে রয়েছে দুর্লভ ইনুইট সীলচর্মের তৈরি কায়াক, এমব্রয়ডারি করা ক্রি চামড়ার মোজা, ২০০ বছরের পুরনো একটি ওয়াম্পাম বেল্ট, গুইচিন সম্প্রদায়ের শিশুদের পরিধানের বেল্ট এবং একটি বেলুগা দাঁতের নেকলেস।

আদিবাসী নেতাদের মতে, এই নিদর্শনগুলো এক সময়কার সাংস্কৃতিক ধ্বংসের সাক্ষী। এক শতাব্দী আগে মিশনারিরা দূরবর্তী দেশগুলো থেকে এগুলো সংগ্রহ করে, যা এক অর্থে তাদের বিজয়ের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হত।

কানাডার আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি ক্যাথলিক চার্চের অপকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে এই শিল্পকর্মগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি একে ‘অনুশোচনা তীর্থযাত্রা’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।

কিন্তু কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও, মূল্যবান এই শিল্পকর্মগুলো এখনও ভ্যাটিকানের জাদুঘর এবং স্টোরেজেই রয়ে গেছে।

কানাডার আদিবাসী নেতারা এখন পোপ ফ্রান্সিসের শুরু করা কাজটি সম্পন্ন করার জন্য পোপ লিও-কে আহ্বান জানাচ্ছেন।

এই প্রসঙ্গে ‘ফার্স্ট নেশন্স’-এর অ্যাসেম্বলির জাতীয় প্রধান সিন্ডি উডহাউস নেপিনাক বলেন, “যে জিনিসগুলো কারও অধিকার নেই, সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে।”

২০২২ সালে আদিবাসী, ইনুইট ও মেটিজ প্রতিনিধিদের একটি দল কানাডার চার্চ-পরিচালিত আবাসিক স্কুলগুলোতে হওয়া ঐতিহাসিক নির্যাতনের বিষয়ে পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে আলোচনার জন্য রোমে গিয়েছিলেন। সেখানেই তারা ভ্যাটিকানের সংগ্রহশালা পরিদর্শন করেন এবং নিজেদের সম্প্রদায়ের মূল্যবান নিদর্শনগুলো সেখানে সংরক্ষিত অবস্থায় দেখতে পান।

মেটিজ ন্যাশনাল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ভিক্টোরিয়া প্রুডেন বলেন, “মেটিজ, ফার্স্ট নেশন্স বা ইনুইট—যাই হোক না কেন, তাদের শিল্পকর্মগুলো এত দূরে, এটা সত্যিই খুব আবেগপূর্ণ অভিজ্ঞতা ছিল।”

পোপ ফ্রান্সিস পরবর্তীতে কানাডা সফর করেন এবং আবাসিক স্কুলগুলোতে চার্চের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চান। এরপরই তিনি আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে এইসব নিদর্শন ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন।

পোপ লিও-কে সম্প্রতি তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানে দেখা গেলেও, এই বিষয়ে তিনি এখনো কোনো মন্তব্য করেননি। ভ্যাটিকান জাদুঘরও এই বিষয়ে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।

আদিবাসী শিল্পকর্মগুলো কীভাবে পোপের সংগ্রহে এল, তার পেছনে রয়েছে একটি দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯২২ সাল থেকে ক্যাথলিক চার্চের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা পোপ একাদশ পিয়াস মিশনারিদের কাজকে উৎসাহিত করতেন।

ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট হিস্ট্রির অধ্যাপক গ্লোরিয়া বেল বলেন, “পোপ একাদশ পিয়াসের নির্দেশে আদিবাসী জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছু সংগ্রহ করতে বলা হয়েছিল।

তাদের পবিত্র জিনিসপত্র, ভাষা বিষয়ক উপাদান এবং এমনকি সম্ভব হলে আদিবাসী মানুষদেরও পাঠাতে বলা হয়েছিল।”

বেল তার ‘ইটারনাল সভরেইনস: ইন্ডিজেনাস আর্টিস্টস, অ্যাক্টিভিস্টস, অ্যান্ড ট্রাভেলার্স রিফ্রেমিং রোম’ বইতে লিখেছেন, “পোপ একাদশ পিয়াসের লোভ মেটানোর জন্য আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে হাজার হাজার জিনিস চুরি করা হয়েছিল।”

কানাডার আদিবাসী জনগণের সাংস্কৃতিক পরিচয় যখন মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলছিল, ঠিক সেই সময়েই চার্চ এই সংগ্রহ তৈরি করে।

আদিবাসী শিশুদের আবাসিক বিদ্যালয়ে পাঠানো হতো, যেখানে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা করতে দেওয়া হতো না।

এমনকি, তাদের কঠোর শাস্তিও দেওয়া হতো। এই স্কুলগুলোতে নির্যাতনের কারণে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

১৯২৫ সালে ভ্যাটিকান মিশন এক্সপোজিশনে এই শিল্পকর্মগুলো প্রদর্শন করা হয়, যা চার্চের বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের একটি অংশ ছিল।

এই প্রদর্শনীতে কয়েক মিলিয়ন মানুষ অংশ নিয়েছিল।

ভ্যাটিকান দাবি করে যে, এই শিল্পকর্মগুলো পোপের প্রতি উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল।

তবে গ্লোরিয়া বেলের মতে, এটি একটি ‘মিথ্যা বর্ণনা’, যা বস্তুগুলো কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছিল, সেই প্রেক্ষাপটকে বিবেচনা করে না।

আদিবাসী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি কেড়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন একজন হলেন লাউরি ম্যাকডোনাল্ড। তিনি ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে মাস্কেকোসিহক-এর একটি আদিবাসী রিজার্ভে বেড়ে উঠেছেন।

তিনি জানান, “আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এবং ঔষধ ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। আমরা যদি তা করতাম, তাহলে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে আমাদের সম্পর্কে জানানো হতো।”

২০২২ সালে পোপ ফ্রান্সিস যখন তাঁর প্রাক্তন স্কুলের স্থানে দাঁড়িয়ে ক্যাথলিক চার্চের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়েছেন, তখন ম্যাকডোনাল্ড সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

পোপ ফ্রান্সিস ক্ষমা চাওয়ার পরে, কানাডার অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে এর গভীর তাৎপর্য ছিল।

তবে, এই ক্ষত সহজে সারার নয়। আদিবাসী নেতারা চান পোপ লিও যেন পোপ ফ্রান্সিসের শুরু করা কাজটি সম্পন্ন করেন এবং সবার আগে শিল্পকর্মগুলো ফিরিয়ে দেন।

ম্যাকডোনাল্ড বলেন, “এই জিনিসগুলো আমাদের কাছে হয়তো সাধারণ কিছু, কিন্তু আমাদের জন্য এগুলো ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

জাতিসংঘের আদিবাসী জনগণের অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রের (ইউএনডিক্লারেশন অন দ্য রাইটস অফ ইন্ডিজিনাস পিপলস – ইউএনডিপ) ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আদিবাসী জনগণের তাদের আনুষ্ঠানিক বস্তু ব্যবহারের এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে এবং রাষ্ট্র সেগুলোকে ফিরিয়ে দিতে সচেষ্ট হবে।

২০২৩ সালে আদিবাসী শিল্পকর্ম ফিরিয়ে দেওয়া নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “কানাডার সঙ্গে আমরা অন্তত এটা করতে রাজি হয়েছি।”

তিনি এই প্রসঙ্গে সপ্তম আজ্ঞা – ‘তুমি চুরি করিও না’ – উল্লেখ করে এর প্রতি সমর্থন জানান।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘর তাদের সংগ্রহে থাকা চুরি হওয়া বা অনৈতিকভাবে অর্জিত জিনিসগুলো তাদের উৎস দেশে ফেরত পাঠিয়েছে।

কানাডার আদিবাসী নেতারা চান, তাঁদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীকগুলো দ্রুত ফিরিয়ে দেওয়া হোক।

তাঁরা বিশ্বাস করেন, এর মাধ্যমে তাঁদের পূর্বপুরুষদের আত্মাকে সম্মান জানানো হবে এবং তাঁদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে।

তথ্যসূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *