ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক সংকট: মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রার অবমূল্যায়নে গভীর হচ্ছে সঙ্কট, জরুরি অবস্থা ঘোষণা মাদুরোর।
ভেনেজুয়েলার অর্থনীতিতে আবারও গভীর হচ্ছে সংকট। একদিকে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে দেশটির মুদ্রা বলিভারের (Bolivar) অবমূল্যায়ন সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো পরিস্থিতি মোকাবিলায় ‘অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছেন।
সম্প্রতি, ভেনেজুয়েলার জেলে এরিক ওজেদা জানিয়েছেন, তিনি চিংড়ি মাছ ধরতে গিয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছেন। তার বোন এবং সদ্যোজাত শিশুর জন্য হাসপাতালে অপেক্ষা করছেন তিনি, কিন্তু তাদের কাছে যাওয়ার মতো কোনো উপায় নেই।
এরিক এবং অন্যান্য জেলেরা সবাই কঠিন সময় পার করছেন। গত কয়েক সপ্তাহে তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক মন্দা আরও গভীর হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে চলা এই সংকট বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার পর ভেনেজুয়েলার বাজারে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ বাড়লেও তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মূলত, সরকারের কিছু নীতির কারণে পরিস্থিতি এমন হয়েছে।
এর মধ্যে অন্যতম ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর থেকে মূল্য নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া এবং মার্কিন ডলার ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া। এছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে কোটি কোটি ডলার সরবরাহ করে বলিভারের মান ধরে রাখার চেষ্টা করছিল।
সরকারের এমন পদক্ষেপে ২০১৮ সালে দেশটির ১৩০,০০০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া অতি-মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভেনেজুয়েলার জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রায় ৮০ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল।
এরপর ২০২২ সালে জিডিপি-র বৃদ্ধি ছিল ৮ শতাংশ।
পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর রাজধানী কারাকাসে (Caracas) আমদানি করা পণ্যের দোকান, রেস্টুরেন্ট এবং অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে শুরু করে। রাইড শেয়ারিং ও খাদ্য সরবরাহকারী অ্যাপগুলোর ব্যবহারও বাড়ে।
এমনকি দরিদ্র পরিবারগুলোও ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করে। তবে, এই অর্থনৈতিক উন্নতি মূলত কারাকাস কেন্দ্রিক ছিল। দেশের অন্যান্য শহর, যেমন- তেল শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মারাকাইবোতে (Maracaibo) তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ভেনেজুয়েলার মানুষজন দীর্ঘদিন ধরে ডলারকে একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। তারা অর্থনীতির স্বাস্থ্য পরিমাপ করতে বিনিময় হারের দিকে তাকিয়ে থাকে।
২০২১ সালে মাদুরো সরকার ডলারের বিনিময় হার কমানোর জন্য রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে ১ ডলারের বিপরীতে ৩.৫০ বলিভার পাওয়া যেত।
এর ফলস্বরূপ, খুচরা বাজারে প্রায় ৬৭ শতাংশ লেনদেন বিদেশি মুদ্রায় হতে শুরু করে।
পরে, জ্বালানি কোম্পানি শেভরন (Chevron) ডলার সরবরাহ করতে শুরু করলে সরকারের পক্ষে বিনিময় হার ৩৫ বলিভারের কাছাকাছি ধরে রাখা সম্ভব হয়। কিন্তু, অর্থনীতিবিদরা আগে থেকেই সতর্ক করেছিলেন যে, এই পরিস্থিতি বেশি দিন টিকবে না।
তাদের আশঙ্কা সত্যি করে, গত কয়েক মাসে ডলারের বিপরীতে বলিভারের মান দ্রুত কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে, বাজারে ১ ডলারের বিপরীতে ৭০ বলিভার পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে কালোবাজারে এই হার ১০০ বলিভার পর্যন্ত উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদুরোর পুনর্নির্বাচন, মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল এবং শেভরনের তেল রপ্তানির অনুমতি বাতিলসহ বিভিন্ন কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন বিনিময় হার ব্যবহারের কারণে অনেক পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অর্থনীতিবিদ পেদ্রো পালমার মতে, ভেনেজুয়েলার মুদ্রাস্ফীতি ১৮০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
তিনি সতর্ক করে বলেছেন, মানুষের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য থাকবে না, ফলে অনেকে চাকরি হারাতে পারেন।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাদুরো জাতীয় পরিষদে জরুরি অবস্থা জারির প্রস্তাব করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি কর স্থগিত এবং স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে চাইছেন। তিনি এর জন্য মার্কিন শুল্ককে দায়ী করেছেন।
বর্তমানে, অনেক কোম্পানি কর্মীদের ডলারে বেতন দেওয়ার পরিবর্তে বলিভারে পরিশোধ করছে। ফলে, কালোবাজারে ডলারের চাহিদা বাড়ছে এবং বিনিময় কেন্দ্রগুলো জনসাধারণের জন্য ডলারের পরিমাণ সীমিত করছে।
গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ভেনেজুয়েলার নাগরিকদের মধ্যে দেশত্যাগের প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। তবে, অভিবাসন নীতিতে ট্রাম্প প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে অনেকেই এখন সেই চিন্তা থেকে সরে এসেছেন।
ভেনেজুয়েলার এই অর্থনৈতিক সংকট সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, টাকার মান কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অনেক পরিবারে আর্থিক অনটন দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো কতটা কার্যকর হবে, এখন সেটাই দেখার বিষয়।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস