ভেনেজুয়েলা, দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশ, বর্তমানে গভীর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জীবনযাত্রার মান হ্রাসের কারণে দেশটির সাধারণ মানুষ কঠিন পরিস্থিতির শিকার।
এই সংকটকালে, সেখানকার ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পাদ্রিরা সাধারণ মানুষের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁরা কেবল আধ্যাত্মিক পরামর্শই দেন না, বরং দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীরও ব্যবস্থা করেন।
কারাকাসের (Caracas) পাদ্রি ফার্নান্দা এগলের (Fernanda Eglé) কথা ধরুন। এক সময় তাঁর কাছে এক গ্যাং সদস্য এসে জানতে চেয়েছিল, “আমি কি আমার বন্দুকটা উপাসনার সময় সঙ্গে আনতে পারি?”
এই প্রশ্নটি যেন এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল তাকে। একদিকে ছিল তার চার্চের সদস্যদের নিরাপত্তা, অন্যদিকে ছিল ওই যুবকের ঈশ্বরের পথে ফিরে আসার সম্ভাবনা।
এগলে দ্বিধা করেননি, বরং তিনি ঝুঁকি নিয়ে সেই গ্যাং সদস্যকে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর ভাষায়, “আমি জানতাম, ঈশ্বর তাদের হৃদয়ের পরিবর্তন চান। তাই আমি ‘অপরাধীদের জন্য উপাসনা’ শুরু করি, যেখানে তারা আসতে পারবে।”
ভেনেজুয়েলার বস্তিগুলোতে, যেখানে অপরাধ, মাদকাসক্তি এবং গ্যাং কালচার এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, সেখানে এই পাদ্রিরা নিয়মিত যান। তারা সেখানকার মানুষের জীবনে আশা জাগানোর চেষ্টা করেন।
এই কঠিন কাজটি তাঁদের জন্য সহজ ছিল না। তেলের দাম কমে যাওয়া, দুর্নীতি এবং সরকারের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে গত এক যুগ ধরে চলা অর্থনৈতিক সংকট তাঁদের এই কাজে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে ২০১৩ সাল থেকে বহু মানুষ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে ভুগছেন।
এমন পরিস্থিতিতে, ইভাঞ্জেলিক্যাল চার্চগুলো আশ্রয়স্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই চার্চগুলো মানুষকে সাহস জোগায়, তাদের জীবনে একটি লক্ষ্য দেয় এবং পারস্পরিক সহযোগিতার একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে।
যদিও ভেনেজুয়েলার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন, তবে বিভিন্ন গবেষণা ও স্থানীয়দের মতে, ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টানদের সংখ্যা বাড়ছে।
টুলেইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড স্মাইল্ডের (David Smilde) মতে, এই অঞ্চলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট এর প্রধান কারণ।
তাছাড়াও, ক্যাথলিক চার্চে যাজকের অভাবের কারণেও অনেকে ইভাঞ্জেলিক্যাল চার্চের দিকে ঝুঁকছেন।
পাদ্রি হোসে লুইস ভিলামিজার (José Luis Villamizar) কারাকাসে তাঁর বাড়ি থেকেই একটি ইভাঞ্জেলিক্যাল চার্চ শুরু করেছিলেন।
তিনি দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য নিয়মিত খাদ্য, ওষুধ এবং পোশাক বিতরণ করেন। প্রার্থনা ও ধর্ম বিষয়ক আলোচনার পাশাপাশি, তিনি বিভিন্ন বিনোদনমূলক কার্যক্রম এবং কর্মশালারও আয়োজন করেন।
তাঁর চার্চে আশ্রয় নেওয়া অনেককে তিনি নতুন করে জীবন শুরু করতে সাহায্য করেছেন।
ফার্নান্দা এগলের চার্চে গ্যাং সদস্যরা তাদের অস্ত্র জমা দিয়ে উপাসনায় যোগ দিত। এগলে তাদের সঙ্গে কথা বলতেন, তাদের জীবনের গল্প শুনতেন এবং তাদের কষ্ট অনুভব করতেন।
তিনি তাদের পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেন।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো (Nicolás Maduro) ইভাঞ্জেলিক্যাল সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছেন। তিনি “আমার সুসজ্জিত চার্চ” নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ইভাঞ্জেলিক্যাল চার্চগুলোতে সরকারি অনুদান দিয়েছেন।
তবে, অনেক পাদ্রি এই সাহায্য গ্রহণ করতে রাজি হননি। তাঁদের মতে, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলে ঈশ্বরের কাজে বাধা আসতে পারে।
ডেভিড স্মাইল্ডের মতে, মাদুরোর এই প্রচেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। তিনি আরও মনে করেন, রাজনীতিবিদরা প্রায়ই ইভাঞ্জেলিক্যাল চার্চগুলোর স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যকে ভুলভাবে মূল্যায়ন করেন।
ইসরায়েল গুয়েরা (Israel Guerra) নামের একজন জানান, তিনি আগে ক্যাথলিক ছিলেন, কিন্তু পরে একটি আধ্যাত্মিক সংকটের কারণে ইভাঞ্জেলিক্যাল হন।
তাঁর মতে, ইভাঞ্জেলিক্যাল চার্চগুলো আশ্রয়স্থল এবং এখানে সবাই স্বাগত। সেখানে গরিব-ধনী, গ্যাং সদস্য থেকে উদ্যোক্তা—সবার জন্য জায়গা আছে।
অন্যদিকে, জেনেসিস দিয়াজ (Génesis Díaz) নামের একজন জানান, যদিও সব চার্চ এত উদার নয়, তারপরও ইভাঞ্জেলিক্যাল চার্চগুলোর সংখ্যা বাড়ছে।
তিনি দেখেছেন, কিছু এলাকায় একটি ক্যাথলিক চার্চের বিপরীতে প্রায় ২০টি ইভাঞ্জেলিক্যাল চার্চ রয়েছে। তাঁর মতে, ভেনেজুয়েলা একটি খ্রিস্টান ও ধার্মিক দেশ।
তথ্যসূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস