মহাকাশ গবেষণার জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন ভেরা রুবিন। তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন এবং কঠোর পরিশ্রমে আমরা জানতে পেরেছি, মহাবিশ্বের বিশাল ভান্ডারে লুকিয়ে আছে এক রহস্যময় অচেনা ‘ডার্ক ম্যাটার’ বা কৃষ্ণ বস্তু। এই আবিষ্কারের মাধ্যমেই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেন।
ভেরা রুবিনের জন্ম ১৯২৮ সালে, ওয়াশিংটন ডিসিতে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর আকাশে তারা দেখার প্রতি ছিল গভীর আগ্রহ। রাতের আকাশে তারাদের মিটিমিটি আলো তাঁকে মুগ্ধ করত, আর সেই থেকেই মহাকাশ ও বিজ্ঞান ছিল তাঁর ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু।
তিনি সবসময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, তারাদের পথ খুঁজে বেড়াতেন। বাবার উৎসাহে তৈরি করা টেলিস্কোপের মাধ্যমে রাতের আকাশকে আরও ভালোভাবে দেখার সুযোগ পান তিনি।
১৯৫০-এর দশকে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স এবং পরবর্তীতে জর্জেটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন ভেরা রুবিন। তাঁর গবেষণার মূল বিষয় ছিল ছায়াপথের ঘূর্ণন গতি।
সে সময়ে প্রচলিত ধারণা ছিল, ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে দূরের তারাগুলো ধীরে ধীরে ঘুরবে, অনেকটা সৌরজগতের গ্রহগুলোর মতো। কিন্তু ভেরা রুবিন তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফলাফলে ভিন্ন চিত্র দেখতে পান। তিনি লক্ষ্য করেন, ছায়াপথের প্রান্তেও তারাগুলো একই গতিতে ঘুরছে, যা বিজ্ঞানীদের প্রচলিত ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।
এই পর্যবেক্ষণই ‘ডার্ক ম্যাটার’-এর ধারণা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ভেরা রুবিনের এই যুগান্তকারী আবিষ্কার জ্যোতির্বিজ্ঞানে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাঁর কাজের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, ছায়াপথের ঘূর্ণন গতি শুধু দৃশ্যমান তারার আলোকের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে অদৃশ্য এক ‘ডার্ক ম্যাটার’-এর বিশাল ভাণ্ডার, যা ছায়াপথের ভরকে ধরে রাখতে সাহায্য করে।
বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, এই ‘ডার্ক ম্যাটার’-এর পরিমাণ এত বেশি যে, মহাবিশ্বের মোট ভরের প্রায় ৮৫ শতাংশ জুড়েই এর বিস্তার।
শুধু বিজ্ঞানচর্চায় নয়, নারীদের অধিকার আদায়েও ভেরা রুবিনের অবদান অনস্বীকার্য। বিজ্ঞান জগতে নারীদের সমান সুযোগ ও অধিকারের জন্য তিনি ছিলেন সোচ্চার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দিতে তিনি সবসময় কাজ করে গেছেন।
তাঁর সম্মানার্থে একটি নতুন মানমন্দিরের নামকরণ করা হয়েছে, ‘ভেরা রুবিন মানমন্দির’। এই মানমন্দিরটি মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করবে।
ভেরা রুবিনের আবিষ্কার আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। তাঁর জীবন ও কর্ম তরুণ প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের জন্য এক অনুপ্রেরণা, যিনি প্রমাণ করেছেন, অধ্যবসায়, একাগ্রতা এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে যেকোনো বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।
তাঁর আবিষ্কারগুলো মহাকাশ গবেষণায় এক নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে, যা ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের জন্য অনুসন্ধানের অফুরন্ত সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক