জুতা ছাড়াই গোল! এক ‘মিরাকল’ জয়, ইতালীয় ফুটবলে আলোড়ন!

ইতালীয় ফুটবলে এক অভাবনীয় সাফল্যের গল্প, যা আজও অনেকের কাছে রূপকথা। ১৯৮৪-৮৫ সালের কথা, যখন হেল্লাস ভেরোনা নামের একটি দল ইতালির শীর্ষ ফুটবল লিগ সিরি-আ’তে চ্যাম্পিয়ন হয়।

এই জয় ছিল অপ্রত্যাশিত, কারণ তারা ছিল তুলনামূলকভাবে ছোট একটি ক্লাব, যাদের খেলোয়াড় এবং সমর্থক উভয় দিক থেকে বিশাল দলগুলোর থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। তাদের এই অসাধারণ জয় ফুটবল বিশ্বে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে।

ভেরোনার এই রূপকথার যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০-এর দশকে, যখন তারা সিরি-বি থেকে সিরি-আ’তে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ক্লাবটি ধীরে ধীরে শক্তিশালী হওয়ার পরিকল্পনা করে এবং ১৯৮১ সালে ওসvaldo বাগনোলিকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেয়।

বাগনোলি ছিলেন তুলনামূলকভাবে অপরিচিত একজন কোচ, তবে তার কৌশল এবং খেলোয়াড় বাছাইয়ের ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তিনি এমন কিছু খেলোয়াড়কে দলে ভেড়ান, যাদের হয়তো বড় ক্লাবগুলো থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল নিজেদের প্রমাণ করার অদম্য ইচ্ছা।

গোলরক্ষক ক্লদিও গ্যারেলা, দলের অধিনায়ক রবার্তো ত্রিসেলা, উইঙ্গার পিয়েরিনো ফানা এবং আক্রমণভাগের খেলোয়াড় জিউসেপ গ্যালদেরিসি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম।

বাগনোলির হাত ধরে খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে গঠিত দলটি এক শক্তিশালী দলে পরিণত হয়। ক্লাবের বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের দূরদর্শিতা এবং ক্যানন-এর মত একটি কোম্পানির আর্থিক সহায়তায় তারা ইউরোপ থেকে কিছু প্রতিভাবান খেলোয়াড় দলে ভেড়ায়।

এর মধ্যে ছিলেন জার্মানির হান্স-পেটার ব্রিগেল এবং ডেনমার্কের প্রিবেন এলকিয়ার লারসেন। ব্রিগেল ছিলেন একজন শক্তিশালী লেফট-ব্যাক, আর এলকিয়ার লারসেন ছিলেন আক্রমণভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।

এই দুই বিদেশি খেলোয়াড়ের আগমন ইতালীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনা যোগ করে।

১৯৮৪-৮৫ মৌসুমের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। মারাদোনার অভিষেক ম্যাচে তারা নাপোলিকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে। এরপর পুরো মৌসুমে দলটি ছিল লীগ টেবিলের শীর্ষে।

তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ইন্টার মিলান। তবে, কেউই তাদের শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে তেমন একটা আলোচনা করেনি। মূলত একটি শক্তিশালী দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করাই ছিল লক্ষ্য।

তবে, দলটির খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিল একতা এবং জেতার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। বাগনোলি তার খেলোয়াড়দের মাটিতে থাকতে শিখিয়েছিলেন, এমনকি “স্কুডেত্তো” শব্দটি ব্যবহার করতেও নিষেধ করেছিলেন, যাতে তাদের মধ্যে শিরোপা জয়ের ধারণা তৈরি না হয়।

খেলোয়াড়রা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। ক্রিসমাসের সময় খেলোয়াড় এবং তাদের স্ত্রীদের একটি নৈশভোজে ফানা বলেছিলেন, “বন্ধুরা, এই আমাদের মৌসুম। যদি আমরা এখন না করি, তবে আর কখনোই পারব না।”

এই মৌসুমে ভেরোনার সাফল্যের অনেক উদাহরণ রয়েছে। জুভেন্টাসের বিপক্ষে এলকিয়ার লারসেনের বুট ছাড়া গোল ছিল অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা। এছাড়া, উদিনেজের বিপক্ষে ৫-৩ গোলের জয় এবং এএস রোমার সাথে গোলশূন্য ড্র ছিল তাদের দৃঢ়তার প্রমাণ।

লীগ শিরোপা জয় করার পথে তাদের কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আটালান্টার বিপক্ষে তাদের শেষ ম্যাচে ড্র করলেই চলত। হাজার হাজার সমর্থক সেই খেলা দেখার জন্য মাঠে উপস্থিত ছিলেন।

আটালান্টা প্রথমে ১-০ গোলে এগিয়ে গেলেও, এলকিয়ার লারসেনের গোলে খেলায় সমতা আসে এবং ভেরোনার ঐতিহাসিক শিরোপা জয় নিশ্চিত হয়।

পুরো শহর যেন আনন্দে ফেটে পড়েছিল। ভেরোনার প্রধান চত্বর পিয়াজা ব্রা-তে (Piazza Bra) মানুষের ঢল নামে। খেলোয়াড়রা যখন বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন, তখন স্টেডিয়ামে প্যারাট্রুপার, বেলুন এবং সঙ্গীতের আয়োজন করা হয়েছিল।

বাগনোলি, যিনি এখন শহরের কিংবদন্তি, এই মুহূর্তটি তার নিজস্ব স্টাইলে উদযাপন করেন।

ভেরোনার এই জয় ইতালীয় ফুটবলে নতুন এক পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৯৮৪-৮৫ মৌসুম ছিল এমন একটি সময়, যখন রেফারি নিয়োগের ক্ষেত্রে লটারির ব্যবস্থা ছিল।

অনেকে মনে করেন, এই পদ্ধতির কারণেও ভেরোনার সাফল্য এসেছিল।

তবে, ভেরোনার এই জয় ছিল একটি রূপকথা, যা ইতালীয় ফুটবলে দীর্ঘদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাদের এই জয় প্রমাণ করে, সঠিক পরিকল্পনা, দৃঢ়তা এবং একাগ্রতা থাকলে যেকোনো কিছুই জয় করা সম্ভব।

তথ্য সূত্র: CNN

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *