মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওজন কমানোর ওষুধের ক্রমবর্ধমান দাম সরকারি স্বাস্থ্যখাতে নতুন সংকট তৈরি করেছে। এর ফলে সরকারি স্বাস্থ্য বীমা প্রোগ্রাম, বিশেষ করে মেডিকেড-এর ওপর পড়ছে মারাত্মক চাপ।
উন্নত চিকিৎসার এই উচ্চমূল্যের কারণে ব্যাহত হচ্ছে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা। খবরটি শুনলে মনে হয় যেন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
ওজন কমানোর ওষুধ, যেমন – ওজেম্পিক, উইগোভি এবং জেপবাউন্ড-এর চাহিদা বাড়ছে দ্রুতগতিতে। ডায়াবেটিসের চিকিৎসার পাশাপাশি ওজন কমানোর ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার বাড়ছে।
এই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের স্বাস্থ্যখাতে বাড়ছে ব্যয়ের বোঝা। পেনসিলভানিয়া রাজ্যে শুধু মেডিকেইডের মাধ্যমে এই ওষুধ সরবরাহ করতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ১.৩ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা) খরচ হতে পারে।
যা কয়েক বছর আগের তুলনায় অনেক বেশি। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে রাজ্যটিতে বাজেট ঘাটতির আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। সেখানকার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যারা ওজন কমানোর জন্য এই ওষুধ ব্যবহার করতে চান, তাদের বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) একটি নির্দিষ্ট মানের মধ্যে আনতে হবে।
সেইসঙ্গে ডায়েট ও ব্যায়ামের মতো বিষয়গুলোও অনুসরণ করতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ১৪টি রাজ্যে মেডিকেইডের মাধ্যমে মোটা ব্যক্তিদের জন্য ওজন কমানোর এই ওষুধ সরবরাহ করা হয়। আরো কয়েকটি রাজ্যে এই সুবিধা চালুর জন্য আইন তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে, কিছু রাজ্যে এই প্রস্তাব এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, আবার কোনো কোনো রাজ্যে খরচ কমানোর জন্য পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া এবং নর্থ ক্যারোলাইনা-এর মতো কয়েকটি রাজ্যে কর্মীদের জন্য এই সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কারণ এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
কনটিকাটের বাজেট পরিচালক জেফরি বেকহাম জানিয়েছেন, “বিষয়টি খুবই ব্যয়বহুল, এবং অন্যান্য রাজ্য ও কিছু বেসরকারি স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানিও একই সিদ্ধান্তে আসছে।”
কেএফএফ নামক একটি গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মেডিকেইডের মাধ্যমে এই ধরনের ওষুধের পেছনে খরচ হয়েছিল ৫৭৭.৩ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৬ হাজার ৩শ কোটি টাকা)। যা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৯ বিলিয়ন ডলারে (প্রায় ৪২ হাজার ৭শ কোটি টাকা)।
একই সময়ে এই ওষুধগুলোর ব্যবস্থাপত্র চারগুণ বেড়েছে। প্রতিটি রোগীর জন্য বছরে এই ওষুধের গড় খরচ প্রায় ১২ হাজার ডলার (প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা)।
সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক মানুষ মেডিকেয়ার ও মেডিকেইডের মাধ্যমে মোটা ব্যক্তিদের ওজন কমানোর ওষুধ সরবরাহ করার পক্ষে।
তবে, অনেকে এর বিপক্ষেও মত দিয়েছেন। যেহেতু মেডিকেয়ারে এই ওষুধ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তাই ট্রাম্প প্রশাসনও এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
ওজন কমানোর ওষুধের উচ্চ মূল্যের কারণে অনেক রাজ্যে বাজেট সংকট দেখা দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ, রোগীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
উদাহরণস্বরূপ, কানেকটিকাট রাজ্যে মেডিকেইড প্রোগ্রামে প্রায় ২৯০ মিলিয়ন ডলার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তাই সেখানকার সরকার ২০২৩ সালের একটি নিয়ম বাতিল করার প্রস্তাব করেছে, যেখানে গুরুতর স্থূলতার শিকার রোগীদের জন্য মেডিকেইডের মাধ্যমে ওষুধ সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছিল।
আগামী ১৪ই জুন থেকে রোগীদের ওষুধ পেতে হলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস-এর প্রমাণ দিতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে সারা মাকোউইকি নামের ৪২ বছর বয়সী এক নারী জানিয়েছেন, তিনি এই ওষুধগুলোর কারণে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছিলেন।
সারার মতো আরও অনেকে আছেন যারা এই ওষুধের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ সুবিধা ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ স্থূলতার শিকার। অতিরিক্ত ওজনের কারণে উচ্চ রক্তচাপ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং উচ্চ কোলেস্টেরলের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়, যা স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
আমাদের দেশেও অতিরিক্ত ওজন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উন্নত জীবনযাত্রার কারণে এখানেও বাড়ছে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের জন্য একটি সতর্কবার্তা।
আমাদের দেশেও যদি ওজন কমানোর ওষুধের চাহিদা বাড়ে, তবে তা সরকারি স্বাস্থ্য বীমা প্রোগ্রামগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
তাই, এই ধরনের ওষুধের দাম এবং এর সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি, স্বাস্থ্যখাতে একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস