পশ্চিম পাপুয়ার আদিবাসী জনজাতি তাদের অঞ্চলে পরিবেশ ধ্বংসের (ইকোসাইড) অভিযোগ তুলে কিট-ক্যাট, স্মার্টিজ, অ্যারো চকোলেট, ওরিও বিস্কুট এবং রিটজ ক্র্যাকার সহ প্রসাধনী ব্র্যান্ড প্যান্টিন এবং হার্বাল এসেন্সের পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। এই পণ্যগুলোতে পাম তেল ব্যবহার করা হয় এবং আদিবাসী জনজাতিদের দাবি অনুযায়ী, এই উপাদান সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো সরাসরি পশ্চিম পাপুয়া থেকে তাদের তেল সংগ্রহ করে।
১৯৬৩ সাল থেকে এই অঞ্চলটি ইন্দোনেশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যেখানে কৃষি উন্নয়নের জন্য হাজার হাজার একর বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে।
পশ্চিম পাপুয়ার নব্বইয়ের বেশি আদিবাসী গোষ্ঠী, রাজনৈতিক সংগঠন এবং ধর্মীয় সম্প্রদায় এই বর্জন সমর্থন করেছে। তাদের মতে, পশ্চিম পাপুয়ার জনগণকে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার না দেওয়া পর্যন্ত এই বর্জন অব্যাহত রাখা উচিত।
ইউনাইটেড লিবারেশন মুভমেন্ট ফর ওয়েস্ট পাপুয়া (ইউএলএমডব্লিউপি)-এর মুখপাত্র রাকি আপ বলেছেন, “এই পণ্যগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত। এখানকার আদিবাসীদের হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করা ভূমি থেকে জোর করে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, যার ফলস্বরূপ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।”
রাকি আপ আরও বলেন, “ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করা দেশগুলোর, বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর, এই বিষয়ে নজর রাখা উচিত। তারা যেন বুঝতে পারে কাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এবং কীভাবে তারা কার্যত ইন্দোনেশিয়াকে পশ্চিম পাপুয়ায় ঔপনিবেশিক প্রকল্প, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং পরিবেশ ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর অনুমতি দিচ্ছে।”
পশ্চিম পাপুয়া হলো নিউ গিনি দ্বীপের পশ্চিমাংশ, যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বৃষ্টিপাতের বনভূমি। এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম স্বর্ণ ও তামার খনি, সেইসাথে প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ এবং কাঠের বিশাল ভাণ্ডার।
একসময় এটি কয়েক শতাব্দী ধরে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের অংশ ছিল। ১৯৬৩ সালে বিতর্কিত পরিস্থিতিতে এই অঞ্চলটি ইন্দোনেশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়।
আদিবাসী মেলানেশীয়রা, বর্জন সমর্থনকারীদের মতে, এই সম্পদ থেকে কোনো সুবিধা পায়নি। ১৯৬৩ সাল থেকে তারা ইন্দোনেশিয়ার দখলে রয়েছে এবং ইউএলএমডব্লিউপি এটিকে ‘গোপন গণহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
পশ্চিম পাপুয়ার আদিবাসীদের দাবি, গত ছয় দশকে ইন্দোনেশিয়ার দখলদারিত্বের কারণে তাদের পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। তাদের পূর্বপুরুষদের জমির কয়েক মিলিয়ন একর কর্পোরেট মুনাফার জন্য ধ্বংস করা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া, যা ইতিমধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম পাম তেল রপ্তানিকারক দেশ, বর্তমানে পশ্চিম পাপুয়ায় বিশ্বের বৃহত্তম একক পাম তেল প্ল্যান্টেশন তৈরির কাজ শুরু করেছে। একইসঙ্গে এখানে একটি বিশাল আকারের চিনি ও জৈব জ্বালানি প্ল্যান্টেশনও তৈরি করা হচ্ছে, যা সম্ভবত বৃহত্তম বনভূমি ধ্বংসের প্রকল্প হতে চলেছে।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘তানাহ মেরাহ’ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলো দেশটির পূর্বে ১,৪০,০০০ হেক্টরের বেশি জমিতে পাম তেল বাগান স্থাপন করার পরিকল্পনা করছে – যা ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার দ্বিগুণ।
একই সময়ে, ইন্দোনেশিয়ান কর্তৃপক্ষ দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত মেরাউকে ২ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে বছরে ২৬ লক্ষ টন চিনি এবং ২৪৪ মিলিয়ন লিটার জৈব-ইথানল উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।
রাকি আপ নেদারল্যান্ডস থেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “পশ্চিম পাপুয়ানদের, বিশেষ করে ইউএলএমডব্লিউপি-র অবস্থান খুবই স্পষ্ট: আমরা আধুনিক যুগের একটি কলোনি।
১৯৬২ সালে নেদারল্যান্ডস এবং ইন্দোনেশিয়া একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যেখানে পশ্চিম পাপুয়ার সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি, যা ছিল আমাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার হরণ করার শামিল… এরপর ১৯৬৯ সালে তথাকথিত একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, যা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ন্যায্য ছিল না।
বন্দুকের নলের মুখে ১,০২৫ জন ব্যক্তিকে বাছাই করে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে একীভূত হওয়ার পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। সুতরাং, এটিই হলো ইন্দোনেশিয়ার ঔপনিবেশিক প্রকল্পের ভিত্তি।
আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যখন আমরা ইন্দোনেশিয়ার অংশ হয়েছিলাম, তখন থেকেই গণহত্যা শুরু হয়েছিল।”
কিট-ক্যাট, স্মার্টিজ এবং অ্যারো চকোলেট উৎপাদনকারী নেসলে’র একজন মুখপাত্র বলেছেন, “আমাদের কোম্পানির বনভূমি ধ্বংস-মুক্ত পাম তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করার কঠোর মান রয়েছে।
সরবরাহ শৃঙ্খল চিহ্নিতকরণ, সার্টিফিকেশন, স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ এবং মাঠ পর্যায়ে মূল্যায়নের মতো বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা এটি নিশ্চিত করি।
এ ধরনের কোনো অভিযোগ পেলে আমরা তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করি এবং যথাযথভাবে তদন্ত করি।”
ওরিও এবং রিটজ ক্র্যাকার উৎপাদনকারী মন্ডেলিজ এবং হার্বাল এসেন্স ও প্যান্টিন ব্র্যান্ডের উৎপাদক প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান