পশ্চিমা ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর ভারতে প্রবেশ: সাংস্কৃতিক ভুলগুলো কি বিশাল ক্ষতির কারণ?
ভারতে পশ্চিমা ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর বাজার সম্প্রসারণের এক উজ্জ্বল চিত্র দেখা যাচ্ছে, তবে তাদের কিছু ভুল পদক্ষেপ প্রায়ই বিতর্ক সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি, ইতালীয় ফ্যাশন হাউস প্রাদার একটি ডিজাইন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।
মিলানে তাদের পুরুষদের পোশাক প্রদর্শনীতে, ব্র্যান্ডটি এমন কিছু বাদামী স্যান্ডেল উপস্থাপন করে, যা দেখতে ভারতের ঐতিহ্যবাহী ‘কোলাপুরি চপ্পলের’ মতো ছিল।
কোলাপুরি চপ্পল, যা দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দি থেকে হাতে তৈরি করা হচ্ছে, ভারতের একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প। প্রাদা শুরুতে এই জুতাগুলোর পেছনে ভারতীয় ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হওয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে।
অনেকেই একে ভারতীয় কারুশিল্পীদের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার সামিল হিসেবে দেখেন। সামাজিক মাধ্যমে ডিজাইন চুরির অভিযোগও ওঠে। পরে অবশ্য প্রাদা স্বীকার করে যে তাদের ডিজাইনটি “ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় জুতা” থেকে অনুপ্রাণিত।
ফ্যাশন বিশ্বে ভারতের বাজার দ্রুত বাড়ছে, তাই এই ধরনের ঘটনাগুলো ব্র্যান্ডগুলোর জন্য বেশ উদ্বেগের কারণ। ২০২৩ সালে ভারতের বিলাসবহুল বাজারের আকার ছিল প্রায় ৭.৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৮ সাল নাগাদ ১১.৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই বৃদ্ধি মূলত একটি ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি, নগরায়ণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে সচেতন তরুণ প্রজন্মের কারণে হচ্ছে।
তবে, ভারতীয় ফ্যাশন ডিজাইনার গৌরব গুপ্তের মতে, “ব্র্যান্ডগুলোর উচিত ভারতকে কেবল বাণিজ্যিক সুযোগ হিসেবে না দেখে, একটি সাংস্কৃতিক আলোচনার ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা।” তিনি আরও বলেন, “ভারতীয় ক্রেতারা নিজেদের সংস্কৃতিকে সম্মান করতে চায়।
শুধুমাত্র মুম্বাইয়ে একটি ফ্ল্যাগশিপ (flagship) দোকান খুললেই হবে না, বাজারের আবেগ এবং দৃশ্যমান ভাষা বুঝতে হবে।
পশ্চিমা ফ্যাশন প্রায়ই ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রেরণা নেয়, তবে সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। সম্প্রতি, ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধি, সামাজিক মাধ্যমের প্রসার এবং সাংস্কৃতিক স্ব-অভিজ্ঞতার কারণে এই ধরনের অভিযোগগুলো আরও জোরালো হচ্ছে।
এরকম একটি ঘটনার শিকার হয় ফ্যাশন হাউস গুচি। ২০১৯ সালে, তারা “ইন্দি ফুল টারবান” নামে একটি পাগড়ি বিক্রি করে, যা শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
পরবর্তীতে, বিতর্কিত এই পণ্যটি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
এছাড়াও, পোশাক কোম্পানি রিফর্মেশন (Reformation) একটি ব্লাউজ, স্কার্ট এবং স্কার্ফ বিক্রি করে সমালোচিত হয়েছিল, যা দক্ষিণ এশীয়দের কাছে ‘লেহেঙ্গা’র মতো মনে হয়েছিল।
একইভাবে, এইচএন্ডএম (H&M) একটি টপ ও প্যান্টের সেট বিক্রি করে বিতর্কের জন্ম দেয়, যা ‘সালোয়ার কামিজ’-এর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল।
তবে, সব ব্র্যান্ড যে একই রকম ভুল করে, তা নয়। কিছু ব্র্যান্ড ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা দেখিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ডিওর (Dior) মুম্বাইয়ের গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়াতে একটি ফ্যাশন শো করে, যেখানে ভারতীয় কারুশিল্পকে সম্মান জানানো হয়।
নাইকি (Nike) সম্প্রতি একটি ভারতীয় ফ্যাশন লেবেলের সঙ্গে তাদের প্রথম সহযোগিতা শুরু করেছে, যা প্রাচীন টাই-ডাই কৌশল থেকে অনুপ্রাণিত।
এই প্রসঙ্গে, ফ্যাশন বিষয়ক সমালোচক এবং ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট ‘ডায়েট সাবিয়া’র মতে, “যখন ভারতকে পরবর্তী বৃহত্তম বিলাসবহুল বাজার হিসেবে দেখা হচ্ছে, তখন এটিকে একটি সাধারণ গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।
কিছু ব্র্যান্ড অবশেষে আমাদের বিশ্বব্যাপী টেক্সটাইল পাওয়ার হাউস হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে – তবে এটি এখনো যথেষ্ট নয়। দৃশ্যমানতা শুরু, কিন্তু সমতা অর্জনই চূড়ান্ত লক্ষ্য।”
ভারতের বাজারে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে হলে, পশ্চিমা ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোকে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। একই সঙ্গে, স্থানীয় কারুশিল্পীদের কাজের স্বীকৃতি এবং তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করা অপরিহার্য।
তথ্য সূত্র: CNN