মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক উদ্বেগ বাড়ছে, বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে অস্থির হোয়াইট হাউস।
যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে হোয়াইট হাউস। দেশটির অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে এমনটা দেখা যাচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর বাণিজ্য নীতি কার্যকর করতে আরও বেশি সময় চাইছেন। খবর সিএনএন-এর।
ক্ষমতায় আসার ১০০তম দিনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকান অর্থনীতির ‘সোনালী যুগ’ শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর নতুন শুল্ক নীতির কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে বলে তিনি জানান।
তবে ১০১তম দিনে তিনি সতর্ক করে বলেন, শুল্ক বৃদ্ধির কারণে চীন থেকে আসা খেলনার দাম বাড়লে শিশুদের খেলনার সংগ্রহ কমাতে হতে পারে।
ট্রাম্পের জন্য, একটি অনিশ্চিত অর্থনীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতকে পুনরুদ্ধারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা একটি বার্তা দেওয়ার মতো চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি মূল্য কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এখন তিনি কীভাবে মার্কিনিদের বোঝাবেন যে, তাঁদের আসলে উচ্চ মূল্যের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে?
এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের কৌশল হলো— ভালো দিকগুলো তুলে ধরা এবং খারাপের জন্য তাঁর পূর্বসূরি জো বাইডেনকে দায়ী করা। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) খারাপ হওয়ার জন্য বাইডেনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাইডেনের নাম নেওয়া হয় ৫১ বার।
ট্রাম্প তাঁর শ্রোতাদের ওপর ভিত্তি করে মাঝে মাঝেই তাঁর বার্তা পরিবর্তন করেন। ডেট্রয়েটের কাছে এক সমাবেশে তিনি শুল্কের কারণে সৃষ্ট ‘অস্থায়ী অসুবিধা’ সম্পর্কে তেমন কিছু বলেননি।
কিন্তু এর একদিন পরেই তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, আমেরিকানদের তাঁদের ভোগ ও ব্যয়ের অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হতে পারে।
তিনি বলেন, “আপনারা হয়তো বলছেন, দোকানগুলোতে জিনিস পাওয়া যাবে না। হয়তো শিশুদের ৩০টির পরিবর্তে ২টি পুতুল রাখতে হবে এবং সেই দুটি পুতুলের দাম স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি হবে।”
মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের ফলস্বরূপ যে সংকট আসতে পারে, সে বিষয়ে ট্রাম্পের এটি ছিল সুস্পষ্ট সতর্কবার্তা। যদিও তিনি যুক্তি দিয়েছেন, এর চূড়ান্ত ফল ভালো হবে।
আলোচনা সূত্রে জানা যায়, কর্মকর্তারা ডিল বা ঘোষণা তৈরি করতে তীব্র চাপ অনুভব করছেন। বিশেষ করে নতুন বাণিজ্য চুক্তিগুলো দ্রুত করতে চাচ্ছেন তাঁরা।
এর মাধ্যমে অর্থনীতির জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সুসংবাদ পাওয়া যেতে পারে।
প্রেসিডেন্ট যদিও মার্কিন অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য শুল্কের ধারণায় অবিচল, উপদেষ্টারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে তিনি ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছেন।
প্রেসিডেন্টসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা এবং ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট ও বাণিজ্য সচিব হাওয়ার্ড লুটনিকের মতো শীর্ষ অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা প্রকাশ্যে নতুন বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের কাছাকাছি আসার কথা জানিয়েছেন।
বুধবার রাতে নিউজ নেশন টাউন হলে ট্রাম্প বলেন, তাঁর প্রশাসন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের সঙ্গে ‘সম্ভাব্য চুক্তি’ করতে পারে। এর আগে, প্রশাসনের কর্মকর্তারা বারবার বলেছিলেন যে তাঁরা নয়াদিল্লির সঙ্গে একটি চুক্তি চূড়ান্ত করার কাছাকাছি রয়েছেন।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতিনিধিরা আলোচনার জন্য ওয়াশিংটনে ছিলেন। তাঁরা বেশ কিছু প্রস্তাব ও ছাড় নিয়ে এসেছেন।
ট্রাম্প যে ২৬ শতাংশ শুল্কের হুমকি দিয়েছেন, সেই শুল্ক কমানোর লক্ষ্যে বাণিজ্য চুক্তি করতে তাঁরা আগ্রহী।
আলোচনায় জড়িত এক ব্যক্তি বলেছেন, “এই বার্তাটি কৌশলগত। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা স্বীকার করেছেন যে, অর্থনীতির বিষয়ে তাঁদের বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা ‘প্রয়োজনীয় স্থানে’ নেই।”
কিছু রিপাবলিকানও আশা করেন, বাণিজ্য চুক্তিগুলোর দ্রুত সমাধান হলে ট্রাম্প অর্থনৈতিক বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা ফিরে পেতে পারেন। নর্থ ক্যারোলিনার রিপাবলিকান সিনেটর থম টিলিস স্বীকার করেছেন, বুধবারের জিডিপি রিপোর্ট উদ্বেগের কারণ।
তিনি বলেন, “আজকের পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বলা যায় না।” তিনি আরও বলেন, শুল্কের প্রভাব ‘খুচরা পর্যায়ে’ দেখা যেতে শুরু করবে, যা আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভোক্তাদের দামে প্রভাব ফেলবে।
হোয়াইট হাউসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলছেন, অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি ঘোষণা করার পর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করবে।
সম্প্রতি ট্রাম্পের কর পরিকল্পনা নিয়েও জোর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০১৭ সালের কর कटौतीকে স্থায়ী করা।
বেসেন্ট এই সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি জুলাই মাসের শুরুতেই একটি কর প্যাকেজ চূড়ান্ত করতে চান। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহলে ধারণা করা হচ্ছে, প্রেসিডেন্টের কর পরিকল্পনার আরও অগ্রগতি অর্থনৈতিক পরিবেশকে আরও উন্নত করবে।
হোয়াইট হাউসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন, “আমরা এটিকে একটি মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে দেখছি।” তাঁদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘আরও ন্যায্য’ বাণিজ্য ব্যবস্থা তৈরি করতে বিশ্ব অর্থনীতির বিন্যাস পরিবর্তন করা ‘এক রাতের মধ্যে’ সম্ভব নয়।
তবে অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে নীরব উদ্বেগ বাড়ছে। ট্রাম্পের পরিকল্পনা তৈরিতে জড়িত অনেক ব্যক্তি দ্রুত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করতে চান।
তাঁদের মতে, এর মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতিগুলোর সুফল তুলে ধরা সম্ভব হবে।
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প জানাচ্ছেন, তাঁর অর্থনৈতিক নীতিগুলো কার্যকর করতে আরও বেশি সময় দরকার।
শুল্ক, কর এবং অন্যান্য বিষয় বাস্তবায়নের জন্য একটা পরিবর্তনের সময় প্রয়োজন।
বুধবার সন্ধ্যায় নিউজ নেশন টাউন হলে তিনি কত দিন সময় নেবেন, তা বলতে রাজি হননি। ট্রাম্প স্বীকার করেছেন, তাঁর শুল্ক কৌশলে ঝুঁকি রয়েছে এবং এটি আমেরিকানদের কাছে বিক্রি করতে হবে।
নির্বাচনের আগে তিনি আমেরিকানদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
নির্বাচনের আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, “আমরা দাম কমিয়ে দেব। আমরা আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারি এবং আমাদের দেশকে পূর্ণ সমৃদ্ধি, বিস্ফোরক প্রবৃদ্ধি এবং সর্বোচ্চ শক্তিতে ফিরিয়ে আনতে পারি।”
এখনও ট্রাম্প বাইডেনকে দোষারোপ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাঁর উপদেষ্টারাও দ্রুত বাইডেনের নাম উল্লেখ করেন, যা ট্রাম্পকে খুশি করে।
বুধবার বিকেলে হোয়াইট হাউসে সিইও-দের এক সমাবেশে ট্রাম্প বলেন, “এটা বাইডেনের অর্থনীতি। আমার মনে হয়, আমাদের কাজ করার জন্য কিছুটা সময় দিতে হবে। তবে এটা এখনো বাইডেনের অর্থনীতি।”
এমনকি ট্রাম্পের কিছু সমর্থকও এই ব্যাখ্যায় আস্থা রাখতে পারছেন না।
বারস্টুল স্পোর্টসের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাম্প সমর্থক ডেভ পোর্টনয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, “পুরোনো একটি কথা আছে, ‘আমার পিঠে প্রস্রাব করে বলিস না বৃষ্টি হচ্ছে’। এখানেও তাই ঘটছে। শেয়ার বাজার ট্রাম্পের প্রথম ১০০ দিনের সরাসরি প্রতিফলন। এর মানে এই নয় যে, এটি ভালো হবে না এবং আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে না।
তবে এটা তাঁর বাজার, বাইডেনের নয়।”
বুধবার মন্ত্রিসভার সদস্যরা বাইডেনকে দোষারোপ করার চেষ্টা করেন। টেবিলে বসে ট্রাম্প তা শুনে হাসছিলেন।
অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী ডগ বার্গাম বলেন, “বাইডেন প্রশাসন আমাদের একটি কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে—পুরো বাণিজ্য দল, পুরো মন্ত্রিসভা।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, “আমরা বাইডেনের অধীনে একটা বিপর্যয় দেখেছি।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন