ওয়াইন বোতলের ছিপি: ট্রাম্পের শুল্কের ধাক্কা থেকে কিভাবে বাঁচল?

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতিতে কর্ক-এর মুক্তি: পর্তুগালের জন্য জয়

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সবসময়ই নানা ধরনের জটিলতা নিয়ে আসে, বিশেষ করে যখন বিভিন্ন দেশের মধ্যে শুল্ক বা ট্যাক্স আরোপ করা হয়। তবে, এই জটিলতার মাঝেও কিছু বিষয় থাকে যা ব্যতিক্রমী।

সম্প্রতি, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করা হলেও, এর ব্যতিক্রম ছিল কর্ক বা বোতলের ছিপি। এই বিশেষ ছাড়টি পর্তুগালের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ তারা বিশ্বের বৃহত্তম কর্ক উৎপাদনকারী দেশ।

কর্ক আসে কর্ক ওক গাছের বাকল থেকে, যা মূলত ভূমধ্যসাগরের কাছাকাছি অঞ্চলে জন্মায়। এই গাছের বাকল থেকে তৈরি হওয়া ছিপিগুলো প্রধানত ওয়াইন বোতল বন্ধ করতে ব্যবহৃত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেকার একটি বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী, কর্ককে ‘অনুপলব্ধ প্রাকৃতিক পণ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ফলে, অন্যান্য কিছু পণ্যের মতো, যেমন বিমান এবং সাধারণ ঔষধ, এইগুলিও ১৫ শতাংশ শুল্কের আওতামুক্ত ছিল।

পর্তুগালের কূটনীতিকরা এই ছাড়ের জন্য উভয় আমেরিকাতেই সক্রিয়ভাবে চেষ্টা চালিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাকৃতিক কর্ক কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক প্যাট্রিক স্পেনসার, ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন বাণিজ্য কর্মকর্তাদের কাছে কর্ক-এর উৎস সম্পর্কে বিস্তারিত জানান এবং শুল্ক মওকুফের আবেদন করেন।

ক্যালিফোর্নিয়ার ওয়াইন প্রস্তুতকারকদের প্রতিনিধিত্বকারী ‘ওয়াইন ইনস্টিটিউট’ও এই বিশেষ ছাড়ের জন্য চেষ্টা করে।

স্পেনসার জানান, যখন আগস্ট মাসে ইউএস-ইইউ চুক্তির সারসংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়, সেখানে কর্কের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল, তখন তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি মজা করে বলেন, “সেদিন আমাদের এলাকায় আনন্দের দিন ছিল।”

যুক্তরাষ্ট্র পর্তুগালের কর্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র পর্তুগাল থেকে প্রায় ২৪১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের কর্ক আমদানি করেছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি ছিল ওয়াইন, স্পিরিট, জলপাই তেল, মধু এবং অন্যান্য তরল পদার্থের বোতলের ছিপি হিসেবে ব্যবহারের জন্য।

তবে, কর্কের ব্যবহার শুধু বোতলের ছিপিতেই সীমাবদ্ধ নয়। নাসা এবং স্পেসএক্স তাদের রকেটের তাপ সুরক্ষা ব্যবস্থায় এটি ব্যবহার করে। এছাড়াও, খেলাধুলার মাঠের ঘাস এবং বিমানবন্দর রানওয়ের কংক্রিটে শক শোষক হিসেবেও কর্ক ব্যবহার করা হয়।

যদিও ক্যালিফোর্নিয়ার জলবায়ু অনেকটা ভূমধ্যসাগরের মতো, তবুও যুক্তরাষ্ট্রে এখনো কর্ক শিল্প সেভাবে গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে তা বন্ধ হয়ে যায়।

এর প্রধান কারণ হলো, একটি কর্ক গাছ থেকে প্রথমবার বাকল সংগ্রহ করতে ২৫ বছর সময় লাগে। এরপর নতুন বাকল গজাতে আরও নয় বছর সময় লাগে। পর্তুগালের একটি বৃহত্তম কর্ক কোম্পানি, কর্টিসেইরা অ্যামোরিমের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আন্তোনিও অ্যামোরিম বলেন, “আমেরিকানরা এত দীর্ঘ সময় ধরে গাছের ফল সংগ্রহের জন্য অপেক্ষা করতে রাজি নয়।”

কর্ক সংগ্রহ একটি বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন কাজ। কারণ, গাছকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে বাকল তোলার জন্য বিশেষ জ্ঞান প্রয়োজন। স্পেনসার আরও জানান, কর্ক সংগ্রহকারীরা ইউরোপের সবচেয়ে বেশি বেতন পাওয়া কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে অন্যতম।

বর্তমানে, ওয়াইন প্রস্তুতকারকরা বোতলের ছিপি হিসেবে কর্কের পাশাপাশি অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক এবং কাঁচের তৈরি বিকল্পগুলির ওপরেও ঝুঁকছেন। তবে, প্রাকৃতিক কর্কের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রিমিয়াম ওয়াইনের ৫৩ শতাংশ কর্ক ব্যবহার করত, যেখানে ২০২২ সালে তা বেড়ে ৬৪.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

ক্যালিফোর্নিয়ার ডেভিসের রবার্ট মন্ডাভি ইনস্টিটিউট অফ ওয়াইন অ্যান্ড ফুড সায়েন্সের পরিচালক এবং রসায়নবিদ অ্যান্ড্রু ওয়াটারহাউস জানান, আগে প্রাকৃতিক কর্কের কারণে ওয়াইনে এক ধরনের গন্ধ সৃষ্টি হতো, যা ‘কর্ক টেইন্ট’ নামে পরিচিত ছিল।

তবে, কর্ক শিল্প এই সমস্যা সমাধানে অনেক দূর এগিয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এই ধরনের ঘটনাগুলো বিশ্ব অর্থনীতির গতিপথকে প্রভাবিত করে। শুল্কনীতি, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তি—এসব কিছুই একটি দেশের অর্থনীতিকে নতুন দিকে চালিত করতে পারে।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *