শিরোনাম: স্মৃতি ধরে রাখতে অভিনব উপায়, সিরামিকের পাতায় প্রিয়জনের হাতের লেখা
কাগজের টুকরোর ওপর প্রিয়জনের হাতে লেখা চিঠি, যা হয়তো তুলে রাখা হয় ড্রয়ারের গভীরে, কালের স্রোতে ধীরে ধীরে যার কালি ফিকে হয়ে আসে।
কিন্তু ভালোবাসার স্মৃতিকে ধরে রাখার এক অসাধারণ উপায় খুঁজে বের করেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার শিল্পী কারিনা ব্ল্যাক।
সিরামিক শিল্পী কারিনা তাঁর ‘ইটারনাল নোট’ -এর মাধ্যমে কাগজের স্কেচগুলিকে রূপ দেন দীর্ঘস্থায়ী সিরামিক শিল্পকর্মে, যা ভালোবাসার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।
কারিনার এই যাত্রা শুরু হয় কৌতূহল থেকে।
তিনি জানান, “আমি কখনোই সিরামিক শিল্পী হতে চাইনি, কিন্তু নিজের ভেতরের অপূর্ণতাকে খুঁজে পাওয়ার এক অদম্য ইচ্ছা আমাকে এই পথে নিয়ে আসে।
প্রথমে এটা ছিল নিছকই একটি শখের মতো, কিন্তু পরে এটি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে পরিণত হয়েছে।”
আগে কারিনা সোশ্যাল মিডিয়া এবং মার্কেটিং নিয়ে কাজ করতেন।
২০১৮ সালে তিনি শখের বশে সিরামিক তৈরি শুরু করেন।
এরপর ধীরে ধীরে এই শিল্পকর্মই তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।
নভেম্বর ২০২৩-এ তিনি পুরোদমে এই পেশায় আসেন।
কারিনা বলেন, “এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আমার জীবনের অন্যতম কঠিন এবং একইসাথে সবচেয়ে আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা।”
তাঁর বোন কারিনাকে সিরামিক তৈরিতে উৎসাহিত করেছিলেন।
বোনের পরামর্শে তিনি ছবি তোলার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করতে শুরু করেন।
এর কিছুদিন পরেই বোন তাঁকে একটি সিরামিকের চাকা এবং কিছু মাটি উপহার দেন।
কারিনা জানান, “আমি সঙ্গে সঙ্গেই এর প্রেমে পড়ে যাই।
এরপর স্টুডিওতে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত ছিল আমার জন্য আনন্দের।”
ভ্যালেন্টাইনস ডে-র জন্য বিশেষ উপহার তৈরির কথা ভাবতে গিয়েই তিনি ‘ইটারনাল নোট’-এর ধারণা পান।
কারিনা জানান, “আমি আমার কাস্টম স্ক্রিপ্ট ক্যাফে মগ তৈরি করছিলাম, কিন্তু তার থেকেও ব্যক্তিগত কিছু তৈরি করতে চাইছিলাম – হয়তো এমন একটি মগ সেট যেখানে সঙ্গীর সাথে গাওয়া গানের কথা লেখা থাকবে।
ফন্ট নিয়ে কাজ করার সময় তাঁর মাথায় আসে, মানুষের হাতের লেখাকে কেন ব্যবহার করা হবে না?
তিনি তাঁর স্বামীর একটি হাতে লেখা নোট দিয়ে এই আইডিয়াটি পরীক্ষা করেন এবং কাগজের মতো দেখতে একটি সিরামিকের ফলক তৈরি করেন।
“যখন আমি সেটি খুলে দেখলাম, আমি যেন নিশ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছিলাম।
আমি বুঝতে পারলাম, আমি এমন কিছু তৈরি করতে চলেছি যা সত্যিই বিশেষ।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি গভীর এক উপলব্ধিতে পৌঁছান।
পাঁচ বছর আগে বাবাকে হারানোর পর, তাঁর কাছে থাকা কিছু হাতে লেখা চিঠির কথা মনে পড়ে।
“কাগজের মোড়কে বন্দী সেই স্মৃতিগুলো যেন এক একটি টাইম ক্যাপসুল।
আমি অনুভব করলাম, এগুলোকে ধরে রাখার এমন একটি উপায় তৈরি করা যায়, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকবে।
কারিনার কাজে এই বৈপরীত্যটা সবসময় দেখা যায়: ক্ষণস্থায়ী শব্দগুলি একটি স্থায়ী উপাদানে বন্দী হয়।
তিনি বলেন, “আমি সবসময় চেয়েছি সিরামিক যেন একটি মুহূর্তকে ধরে রাখতে পারে।
এটি খুবই টেকসই একটি উপাদান।
যত্ন নিলে এটি শত শত বছর ধরে টিকে থাকতে পারে।
একটি ভঙ্গুর কাগজের টুকরোকে এমন একটি বস্তুতে পরিণত করা, যা শক্ত, স্থায়ী এবং ভাস্কর্যের মতো দেখতে, এতে এক ধরনের সৌন্দর্য রয়েছে।
এই কাজটি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে করতে হয়।
গ্রাহকরা তাঁদের চিঠির একটি স্ক্যান পাঠান, যা কারিনা ডিজিটাইজ করেন এবং এরপর স্টেন্সিল তৈরি করেন।
এরপর নরম, অমসৃণ কাগজের মতো করে মাটি তৈরি করা হয়।
কারিনা বলেন, “মাটি শুকিয়ে গেলে, আমি আন্ডারগ্লেজ ব্যবহার করে হাতে লেখাগুলো ফুটিয়ে তুলি।
এরপর হাতে কলমে প্রতিটি লাইনে রঙ করি, খোদাই করি এবং সূক্ষ্মভাবে কাজ করি, যাতে আসল লেখার প্রতিটি বিবরণ অক্ষুণ্ণ থাকে।
প্রতিটি শিল্পকর্ম দু’বার পোড়ানো হয় এবং তৈরি হতে প্রায় চার সপ্তাহ সময় লাগে।
কিছু নোট তৈরি করার পর কারিনার মনে গভীর দাগ কেটে যায়।
“এমন একটি নোট আছে যা আমি প্রায়ই মনে করি,” কারিনা জানান।
জাপানের একটি রেস্টুরেন্টে তাঁর সঙ্গীর লেখা একটি চিঠি, যা তিনি বিদেশে যাওয়ার আগে লিখেছিলেন।
“মহিলাটি সাত বছর ধরে সেই ছোট নোটটি রেখেছিলেন।
এর নিচে রেস্টুরেন্টের জাপানি লোগো ছিল, যেন এটি একটি টাইমস্ট্যাম্প।
কারিনা বলেন, “আমি একজন রোমান্টিক মানুষ, তাই সেই স্মৃতিটা আমাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়।
তাঁর তৈরি করা শিল্পকর্মগুলির প্রতিক্রিয়া প্রায়ই আবেগপূর্ণ হয়।
“অনেকে বলেছেন, এটা দেখে তাঁদের চোখে জল এসে গিয়েছিল,” তিনি জানান।
“কেউ কেউ এটি তাঁদের বেডরুমে রাখেন এবং প্রতিদিন সকালে ও রাতে পড়েন।
এটাই আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ‘ইটারনাল নোট’-এর চাহিদা বেড়েছে।
কারিনা বলেন, “এটি আমাকে মনে করিয়ে দেয়, মানুষ কতটা গভীর ভাবে স্মৃতি এবং সম্পর্কের আকাঙ্ক্ষা করে।
ভবিষ্যতে, কারিনা ওয়ার্কশপ এবং সরাসরি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে COSA-কে স্টুডিওর বাইরে আরও প্রসারিত করতে চান।
কারিনার মতে, “আমি যা তৈরি করি, তার মূলে রয়েছে এই ধারণা যে সৌন্দর্য এবং স্মৃতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও থাকতে পারে।
হাতে লেখা চিঠি হোক বা আপনার শেলফের একটি সাধারণ জিনিস, আমি চাই প্রতিটি টুকরোই যেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
তথ্য সূত্র: পিপল