বিশ্বের মানুষ কতটা দয়ালু? নতুন রিপোর্টে সুখবর!

বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে উদারতা বাড়ছে, বলছে নতুন এক গবেষণা।

বর্তমান বিশ্বে অনেক সময় কঠিন আর ভয়ের পরিস্থিতি দেখা যায়, তবে একটু ভালোভাবে তাকালে মানুষের মধ্যে ভালো মনের পরিচয় পাওয়া যায়। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বিশ্ব সুখ প্রতিবেদন’ (World Happiness Report) তেমনই একটি ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরেছে।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক, গ্যালুপ, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েলবিং রিসার্চ সেন্টারের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে মানুষের সুখ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমাজের প্রতি তাদের প্রত্যাশার ওপর। এখানে উদারতা বা ‘বেনিভোলেন্স’-কে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে: অর্থ দান, স্বেচ্ছাশ্রম এবং অপরিচিত কারও প্রতি ভালো আচরণ করা।

গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ৭০ শতাংশ মানুষ গত এক মাসে অন্তত একটি ভালো কাজ করেছেন। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং গবেষণাটির সহ-লেখক ড. ফেলিক্স চিয়াং এই সংখ্যাটিকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেন, “আমাদের চারপাশে দশ জনের মধ্যে সাতজন মানুষ ভালো কাজ করেছেন, এই বিষয়টি আমাদের ভালো অনুভব করানো উচিত।”

কোভিড-১৯ মহামারীর সময় উদারতার মাত্রা কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল, তবে এখনকার চিত্র লকডাউনের আগের সময়ের তুলনায় ভালো। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “যদিও বর্তমান বিশ্ব কঠিন মনে হতে পারে, তবে মানুষের এমন ভালো কাজগুলো আমাদের মানসিক শান্তির যোগান দেয়।”

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ভালো কাজ করলে উপকারভোগী এবং যিনি করছেন, উভয়েই সুখী হন। এই উদারতা নিজের এবং সমাজের সামগ্রিক সুখের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

গ্যালুপের পাবলিক সেক্টরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলা আনা রন-লেভি বলেন, “উচ্চ বেতনে চাকরি করার চেয়ে উদারতার মাধ্যমে পাওয়া সুখ বেশি।

কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা অন্যের জন্য অর্থ খরচ করেন, তারা নিজেদের জন্য খরচ করাদের চেয়ে বেশি সুখী হন। যেমন, গবেষকরা অংশগ্রহণকারীদের সামান্য কিছু অর্থ (প্রায় ২ থেকে ৫ ডলার) দিয়ে তা হয় নিজের জন্য, না হয় অন্যের জন্য খরচ করতে বলেন।

দেখা গেছে, যারা অন্যের জন্য খরচ করেছেন, তারা বেশি খুশী হয়েছেন। এই প্রবণতা শুধু একটি দেশে নয়, দক্ষিণ আফ্রিকা, উগান্ডা এবং ভারতের মতো বিভিন্ন দেশেও দেখা গেছে।

অধ্যাপক লারা আকনিন বলেছেন, “আমরা একটি অত্যন্ত সামাজিক প্রজাতি। উদারতার মাধ্যমে আমরা সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করি এবং তা বজায় রাখতে সাহায্য করি।”

আকনিন আরও জানান, মানুষের মধ্যে উদারতা নিয়ে প্রত্যাশা অনেক কম থাকে। তিনি বলেন, “সাধারণভাবে মানুষ একটু বেশি হতাশাবাদী।”

গবেষকরা জানতে চেয়েছিলেন, মানুষজন কোনো হারানো মানিব্যাগ ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে কী ধারণা পোষণ করে। তারা প্রতিবেশী, পুলিশ এবং অপরিচিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই বিষয়ে মানুষের প্রত্যাশা জানতে চান।

গবেষণায় দেখা গেছে, হারানো মানিব্যাগ ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবেশী এবং পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা বেশি, তবে অপরিচিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই আস্থা তুলনামূলকভাবে কম।

আকনিন বলেন, “একজন অপরিচিত ব্যক্তি যদি মানিব্যাগ ফেরত দেন, তবে সেটি সমাজে পারস্পরিক আস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

আকনিন আরও যোগ করেন, মানুষের মধ্যে এই ‘এম্প্যাথি গ্যাপ’ বা সহানুভূতিগত ব্যবধান সুখের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

গবেষকরা কিছু সহজ উপায়ের কথাও বলেছেন যা অনুসরণ করে একজন ব্যক্তি সুখী হতে পারেন। আকনিনের মতে, উদারতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তিনটি ‘সি’ (C) অনুসরণ করা যেতে পারে।

প্রথমটি হলো ‘সংযোগ’ বা কানেকশন তৈরি করা। কাউকে কফি খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালে, ৫ টাকা পাঠানোর চেয়ে বেশি ভালো ফল পাওয়া যায়। দ্বিতীয় ‘সি’ হলো ‘পছন্দ’ বা চয়েস। কোনো বাধ্যবাধকতা থেকে নয়, বরং নিজের ইচ্ছায় ভালো কাজ করলে ভালো লাগে।

তৃতীয় ‘সি’ হলো ‘ইতিবাচক প্রভাব’-এর ধারণা। যে কাজের ফল দেখা যায়, বা কোনো ভালো উদ্দেশ্যে অর্থ দান করলে মানুষ বেশি তৃপ্তি পায়।

এই প্রতিবেদনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে—একাকী খাবার খাওয়ার প্রবণতা। যারা একা খাবার খান, তাদের জীবনযাত্রার মান কম থাকে।

গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকাতে একাকী খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ২০০৩ সাল থেকে এই সংখ্যা ৫৩ শতাংশ বেড়েছে।

রন-লেভি বলেন, “এগুলো সবই পরস্পর সম্পর্কিত। আপনি যদি বেশিরভাগ সময় একা খান, প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ না থাকে, সমাজ এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা কমে যায়, তাহলে উদারতার পরিমাণ কমে যায়, যা আপনার সুখের ওপর প্রভাব ফেলে।”

তবে সুখ আর সামাজিক সম্পর্কহীনতা সবসময় একরকম থাকে না। ফিনল্যান্ড এবং অন্যান্য নর্ডিক দেশগুলো তাদের শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন ও সম্প্রদায়ের কারণে সুখের সূচকে শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *