আতঙ্কে বিশ্ব! সামরিক খাতে ব্যয়ের রেকর্ড, বাড়ছে যুদ্ধের দামামা?

বিশ্বজুড়ে সামরিক ব্যয় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে, যা গত প্রায় চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। ইউক্রেন ও গাজায় চলমান যুদ্ধ এবং এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে এই ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট (SIPRI)। SIPRI-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী সামরিক খাতে ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২.৭১৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি), যা ১৯৮৮ সালের পর থেকে সবচেয়ে বড় বৃদ্ধি।

১৯৮৮ সাল ছিল বার্লিন প্রাচীর পতনের আগের বছর। প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে অস্ত্র প্রতিযোগিতার এই ঊর্ধ্বগতি সহজে থামার কোনো লক্ষণ নেই।

অনেক দেশ সামরিক ব্যয় আরও বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার ফলে আগামী বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে সামরিক খাতে ব্যয় আরও বাড়বে।

সামরিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এখনো শীর্ষস্থানে রয়েছে। ২০২৪ সালে দেশটির সামরিক ব্যয় ছিল প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার।

মার্কিন সামরিক বাজেটে অত্যাধুনিক F-35 যুদ্ধবিমান ও তাদের যুদ্ধ সরঞ্জাম, নৌবাহিনীর জন্য নতুন জাহাজ তৈরি, পারমাণবিক অস্ত্রের আধুনিকীকরণ এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি অন্যতম প্রধান খাত। ইউক্রেনকে সহায়তা হিসেবে দেশটি প্রায় ৪৮.৪ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে, যা কিয়েভের প্রতিরক্ষা বাজেটের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ।

সামরিক ব্যয়ের দিক থেকে চীনের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশটি প্রায় ৩১৪ বিলিয়ন ডলার সামরিক খাতে ব্যয় করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশের সামান্য বেশি।

প্রতিবেদনে বেইজিংয়ের অস্ত্র এবং কমান্ড সংক্রান্ত ব্যয় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়নি, তবে এতে বলা হয়েছে, চীন ২০২৪ সালে নতুন স্টেলথ যুদ্ধবিমান, মনুষ্যবিহীন বিমান এবং পানির নিচে চালিত মনুষ্যবিহীন যানসহ বেশ কিছু উন্নত প্রযুক্তি উন্মোচন করেছে।

এছাড়া, দেশটি তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডারও দ্রুত বাড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন – এই দুটি দেশ একাই ২০২৪ সালে বিশ্বের সামরিক ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক বহন করেছে।

তবে আঞ্চলিক সংঘাত বা উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি রয়েছে এমন দেশগুলোতে সামরিক ব্যয় সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসরায়েল, যারা ২০২৩ সালে গাজায় আক্রমণ শুরু করেছিল, তারা ২০২৪ সালে সামরিক ব্যয় ৬৪ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে।

অন্যদিকে রাশিয়া, যারা ২০২২ সালে ইউক্রেনে আক্রমণ করে, তাদের সামরিক ব্যয় অন্তত ৩৮ শতাংশ বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে SIPRI উল্লেখ করেছে, রাশিয়ার সামরিক ব্যয় সম্ভবত আরও বেশি, কারণ তারা আঞ্চলিক এবং অন্যান্য উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, ন্যাটো দেশগুলো রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় তাদের সামরিক বাজেট উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে।

জার্মানির সামরিক ব্যয় ২৮ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া, রোমানিয়া (৪৩%), নেদারল্যান্ডস (৩৫%), সুইডেন (৩৪%), চেক রিপাবলিক (৩২%), পোল্যান্ড (৩১%), ডেনমার্ক (২০%), নরওয়ে (১৭%), ফিনল্যান্ড (১৬%), তুরস্ক (১২%) এবং গ্রিস (১১%) সহ শীর্ষ ৪০টি ব্যয়কারী দেশের মধ্যে থাকা অন্যান্য ন্যাটো সদস্য দেশগুলোরও দ্বিগুণ হারে সামরিক ব্যয় বেড়েছে।

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোও তাদের সামরিক ব্যয় বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে।

জাপানের সামরিক বাজেট ২০২৪ সালে ২১ শতাংশ বেড়েছে, যা ১৯৫২ সালের পর সর্বোচ্চ। এর ফলে দেশটির জিডিপির ১.৪ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় হচ্ছে, যা ১৯৫৮ সালের পর সর্বোচ্চ।

চীন ও ফিলিপাইনের মধ্যে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বিরোধের কারণে ফিলিপাইন তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় ১৯ শতাংশ বাড়িয়েছে।

যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক ব্যয় ২০২৪ সালে মাত্র ১.৪ শতাংশ বেড়েছে, তবে দেশটির সামরিক ব্যয় জিডিপির ২.৬ শতাংশ, যা পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।

তাইওয়ান, যাদের চীন নিজেদের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে, তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট গত বছর মাত্র ১.৮ শতাংশ বেড়েছে, তবে ২০১৫ সাল থেকে তাইওয়ানের সামরিক ব্যয় ৪৮ শতাংশ বেড়েছে।

অন্যদিকে, ভারতের সামরিক বাজেট ২০২৪ সালে ছিল ৮৬.১ বিলিয়ন ডলার। গত বছর দেশটির ব্যয় ১.৬ শতাংশ বাড়লেও, গত এক দশকে প্রতিরক্ষা ব্যয় ৪২ শতাংশ বেড়েছে।

মিয়ানমারে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে ২০২৪ সালে দেশটির সামরিক ব্যয় ৬৬ শতাংশ বেড়েছে।

দেশটির জিডিপির ৬.৮ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় হয়, যা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।

সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির এই প্রবণতা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে অর্থ বিনিয়োগের পরিবর্তে সামরিক খাতে অর্থ ব্যয় হওয়ায় তা একটি সুযোগের অপচয়।

এছাড়া, বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে তা বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *