মোদীকে মুগ্ধ করার চেষ্টায়, কেন ভারতের বিরুদ্ধে মামলা করছে এক্স?

ভারতে অনলাইন কনটেন্ট সেন্সরশিপ নিয়ে কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করলো ‘এক্স’, মোদীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেও!

ফেব্রুয়ারি মাসে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে স্পেসএক্স এবং টেসলার প্রধান, ইলন মাস্কের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি বৈঠক হয়। মাস্ক মোদীকে একটি উপহার দেন এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।

মোদীর এই সাক্ষাৎকে ‘খুব ভালো’ হিসেবে বর্ণনা করেন। কিন্তু এর এক মাস পরেই, মাস্কের মালিকানাধীন সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘এক্স’ (সাবেক টুইটার) ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে।

তাদের অভিযোগ, সরকার অনলাইনে কনটেন্ট অবৈধভাবে সেন্সর করছে।

এই মামলাটি এমন সময়ে দায়ের করা হয়েছে, যখন মাস্ক ভারতে স্টারলিঙ্ক এবং টেসলা চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, মোদীকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করার সময়েই কেন ‘এক্স’ ভারতের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নিল?

দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কর্ণাটকের হাইকোর্টে দায়ের করা মামলায় ‘এক্স’ অভিযোগ করেছে, ভারত সরকার “একটি বেআইনি সমান্তরাল প্রক্রিয়া” ব্যবহার করছে, যা অনলাইনে কনটেন্ট ব্লক করে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের অনলাইন থেকে অবৈধ কনটেন্ট সরানোর ক্ষমতা দেয়।

এই প্রক্রিয়াটি দেশের তথ্য প্রযুক্তি আইনের অধীনে কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্ধারিত আইনি প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে যায়।

ভারতে ২০০০ সালের অক্টোবর মাসে তথ্য প্রযুক্তি আইন (আইটি অ্যাক্ট) পাস হয়। এই আইনের ৬৯এ ধারা অনুযায়ী, ভারতের তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রক দেশের নিরাপত্তা এবং “জনসাধারণের শালীনতা” রক্ষার স্বার্থে অনলাইনে প্রকাশিত কোনো কনটেন্ট সরানোর অধিকার রাখে।

তবে, এক্ষেত্রে মন্ত্রককে বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, যার মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক্স ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রকের (MeitY) কাছে কনটেন্ট সরানোর অনুমতি চাইতে হয়।

MeitY কনটেন্টটি পরীক্ষা করে, তারপর সেন্সর করার সিদ্ধান্ত নেয়।

কিন্তু এখন, ভারত সরকার কনটেন্ট সরানোর জন্য একটি নতুন প্রক্রিয়া চালু করেছে – আইটি আইনের ৭৯(৩)(বি) ধারা। এই ধারায়, কোনো সরকারি কর্মকর্তার সাধারণ নির্দেশনার মাধ্যমে অনলাইন কনটেন্ট সরানো যায়।

সরকার ‘সহযোগ’ নামের একটি পোর্টালের মাধ্যমে কনটেন্ট সরানোর নোটিশ পাঠাতে পারে, যেখানে কোনো বিচারিক পর্যালোচনার প্রয়োজন হয় না।

ভারত সরকার ‘এক্স’-এর মতো সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোকে ‘সহযোগ’ পোর্টালে যুক্ত হতে বলে।

কিন্তু ‘এক্স’-এর দাবি, এতে তারা “স্বেচ্ছাচারী সেন্সরশিপ”-এর শিকার হবে।

ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং আইনজীবী আপার গুপ্তা আল জাজিরাকে জানান, “সরকার কর্তৃক তৈরি নতুন এই সেন্সরশিপ প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারকে সেন্সরশিপের অনুরোধ জানানোর জন্য কোনো নির্দিষ্ট কর্মকর্তার প্রয়োজন হয় না।

এখন, যেকোনো সরকারি বিভাগ তাদের মনোনীত কর্মকর্তার মাধ্যমে এই ধরনের অনুরোধ পাঠাতে পারে।

ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সদস্য এবং প্রাক্তন তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর একটি ভারতীয় সংবাদ সংস্থাকে জানান, “ভারত এমন একটি দেশ যেখানে আইন সবার জন্য প্রযোজ্য।

‘এক্স’-এর আদালতে যাওয়ার অধিকার আছে।”

এই মামলার শুনানির পরবর্তী তারিখ ২৭শে মার্চ, কর্ণাটক হাইকোর্টে।

বিষয়টি নিয়ে আল জাজিরা ভারতের তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রক এবং ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে।

সম্প্রতি, ‘এক্স’-এর নিজস্ব চ্যাটবট ‘গ্রোক ৩’ (Grok 3) ব্যবহারকারীদের করা কিছু প্রশ্নের উত্তরে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরেছে যা বিজেপি সরকারের কাছে “আপত্তিকর ও বিতর্কিত” বলে মনে হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, যখন একজন ‘এক্স’ ব্যবহারকারী প্রধানমন্ত্রী মোদীর সাক্ষাৎকারগুলি পূর্ব-পরিকল্পিত কিনা জানতে চান, তখন চ্যাটবটটি উত্তর দেয়, “মোদীর সাক্ষাৎকারগুলি প্রায়ই পূর্ব-পরিকল্পিত মনে হয় – তাঁর উত্তরগুলি মার্জিত, সুসংহত এবং খুব কমই মূল বিষয় থেকে বিচ্যুত হয়।

তিনি একটি জনসংযোগের যন্ত্র, ২০১৪ সাল থেকে তাঁর ব্যাপক মাল্টিমিডিয়া কৌশল ব্যবহার করে তাঁর ভাবমূর্তি তৈরি করছেন। আকস্মিক মুহূর্ত? প্রায় নেই বললেই চলে।”

আপার গুপ্তা আরও বলেন, “ভারতে ব্যাপক স্ব-নিয়ন্ত্রণ (self-censorship) দেখা যায়, সেই সঙ্গে ডিজিটাল স্বৈরাচারতন্ত্রের (digital authoritarianism) উত্থান হয়েছে, যেখানে অনেকেই তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে ভয় পান।

‘গ্রোক’ তাঁদের কেন্দ্রীয় সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করার সুযোগ দেয়।

তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই মামলার কারণে মাস্কের ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ভারত-মার্কিন সম্পর্কে খুব বেশি প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম।

কারণ, মাস্কের বিপুল সম্পদ এবং টেলিকম ও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির মতো দ্রুত বর্ধনশীল শিল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ রয়েছে।

ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক, দ্য উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান আল জাজিরাকে জানান, মাস্ক ভারতের বাজারে অনেক সুবিধা ভোগ করেন।

মাস্ক এরই মধ্যে ভারতে স্টারলিঙ্ক পরিষেবা প্রদানের জন্য টেলিকম সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তি করেছেন এবং টেসলা তৈরির একটি কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনাও করছেন।

কুগেলম্যানের মতে, এই মামলাটি মার্কিন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ‘ছোটখাটো সমস্যা’ (blip) হিসাবে বিবেচিত হবে।

ভারতের বিশাল বাজার থেকে দূরে সরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *