ইয়েমেনের একটি দ্বীপে নতুন একটি বিমানঘাঁটি তৈরির খবর পাওয়া গেছে। লোহিত সাগরের এই দ্বীপটিতে ঘাঁটি নির্মাণের পেছনে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরোধিতাকারী একটি পক্ষের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবিগুলোতেই এর প্রমাণ মিলেছে। খবর প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)।
জুকর দ্বীপটিতে তৈরি হওয়া এই বিমানঘাঁটি আন্তর্জাতিক নৌ-চলাচলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চলে অবস্থিত। বাব-আল-মানদেব প্রণালী এবং এডেন উপসাগরের সংযোগস্থলে এর অবস্থান।
এই এলাকা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জাহাজ চলাচল করে। হুতি বিদ্রোহীরা এর আগেও একশ’র বেশি জাহাজে হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে চারটি ডুবে গেছে এবং অন্তত নয়জন নাবিক নিহত হয়েছে।
নতুন এই বিমানঘাঁটি তৈরি হওয়ায় সামরিক শক্তি এই অঞ্চলে আকাশ পথে নজরদারি করতে পারবে।
তবে এই বিমানঘাঁটি সামরিক উদ্দেশ্যে কবে ব্যবহার করা হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), যারা এই অঞ্চলে আরও কয়েকটি বিমানঘাঁটি তৈরি করেছে, তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
ইয়েমেনের হুতি-বিরোধী শক্তিগুলোও এ নিয়ে মুখ খোলেনি। তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ব্যাপক বোমা হামলার পরও তারা হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ শুরু করতে পারেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুকর দ্বীপে ঘাঁটি তৈরি হওয়াটা হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। এই ঘাঁটি হুতি বিদ্রোহীদের অস্ত্র চোরাচালান বন্ধ করতে সহায়তা করবে।
ইতালির আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক এলেওনোরা আর্ডেম্যাগনি বলেন, “জুকরে ঘাঁটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য হলো, হুতিদের চোরাচালান, বিশেষ করে অস্ত্র চোরাচালান বন্ধ করা।”
এপির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, জুকর দ্বীপে প্রায় ২,০০০ মিটার দীর্ঘ একটি রানওয়ে তৈরির কাজ চলছে। দ্বীপটি হুতিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর হোদাইদার প্রায় ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত।
এপ্রিল মাস থেকে এখানে ডক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এরপর রানওয়ের জন্য জায়গা পরিষ্কার করা হয়। আগস্ট মাসের শেষের দিকে রানওয়েতে পিচ ঢালাইয়ের কাজ শুরু হয় এবং অক্টোবর মাসে রানওয়ের চিহ্নিতকরণ সম্পন্ন হয়।
এখন পর্যন্ত কেউ এই নির্মাণ কাজের দায় স্বীকার করেনি। তবে এপির অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুবাই ভিত্তিক একটি কোম্পানির মালিকানাধীন টোগো-পতাকাবাহী ‘বাতসা’ নামের একটি বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ সোমালিল্যান্ডের বেরবেরা থেকে আসার পর প্রায় এক সপ্তাহ ধরে জুকর দ্বীপের নতুন ডকের পাশে অবস্থান করছিল।
এছাড়া, দুবাই ভিত্তিক ‘সেইফ শিপিং অ্যান্ড মেরিন সার্ভিসেস’ নামের একটি কোম্পানি আমিরাত-ভিত্তিক অন্যান্য কোম্পানির পক্ষ থেকে এই রানওয়ে নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় বিটুমিন সরবরাহের নির্দেশ পেয়েছিল।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ইয়েমেনে বেশ কয়েকটি রানওয়ে তৈরি করেছে। লোহিত সাগরে অবস্থিত মোচা শহরে বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ করা হয়েছে, যা এখন বড় আকারের বিমান অবতরণের জন্য উপযোগী।
স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের সঙ্গে ইউএই জড়িত। এছাড়া, ধুবাবেও একটি রানওয়ে তৈরি করা হয়েছে।
আরেকটি রানওয়ে তৈরি হয়েছে ভারত মহাসাগরের আবদ আল-কুরি দ্বীপে, যা এডেন উপসাগরের কাছাকাছি অবস্থিত। বাব-আল-মানদেব প্রণালীতেও ইউএই একটি রানওয়ে তৈরি করেছে, যা মায়ুন দ্বীপে অবস্থিত।
ইউএই-র দীর্ঘদিনের সহযোগী, ইয়েমেনের হুতি-বিরোধী একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি, যা সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল নামে পরিচিত, এই দ্বীপটি নিয়ন্ত্রণ করে এবং তারা বিমানবন্দরের নির্মাণে ইউএই-র ভূমিকার কথা স্বীকার করেছে।
জুকর দ্বীপ লোহিত সাগরে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে অবস্থিত। ১৯৯৫ সালে ইয়েমেনি বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের পর এটি ইরিত্রিয়া দখল করে নেয়।
১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক আদালত দ্বীপটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইয়েমেনের অধীনে ফিরিয়ে দেয়। ২০১৪ সালে হুতি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর জুকর দ্বীপও তাদের দখলে চলে যায়।
২০১৫ সালে সৌদি আরব ও ইউএই ইয়েমেনের তৎকালীন নির্বাসিত সরকারের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয় এবং হুতিদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করে। তারা জুকর দ্বীপ পুনরুদ্ধার করে, যা বর্তমানে ইয়েমেনের প্রয়াত নেতা আলী আবদুল্লাহ সালেহর ভাগ্নে তারিক সালেহর অনুগত নৌবাহিনীর জন্য একটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তারিক সালেহ একসময় হুতিদের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রাখলেও পরে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জুকরে সম্ভাব্য আমিরাতি বিমানঘাঁটি তৈরি হলে হোদাইদা উপকূলের ওপর নজরদারি বাড়বে, যা চোরাচালান বন্ধ করতে এবং ইয়েমেনি বাহিনীকে সহায়তা করতে সহায়ক হবে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস