বোমার শব্দে কেঁপে ওঠা শিশু, আর যুদ্ধের বিভীষিকা: ইয়েমেনের কান্না!

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে, যেখানে জীবন যেন এক অন্তহীন দুঃস্বপ্ন। আকাশ থেকে অবিরাম বৃষ্টির মতো বোমা বর্ষিত হচ্ছে, আর তা কেড়ে নিচ্ছে মানুষের জীবন, কেড়ে নিচ্ছে শিশুদের ভবিষ্যৎ।

এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে, আমেরিকার বিমান হামলা আঘাত হানে আমার পরিবারের বাসস্থানের কাছে, হোদাইদার একটি শান্ত পাড়ায়। বোমা বিস্ফোরণের শব্দ, ঘর কাঁপানো, শিশুদের আর্তনাদ – এই দৃশ্যগুলো যেন ইয়েমেনের প্রতিটি পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী।

ইয়েমেনে যুদ্ধের দশ বছর পার হয়ে গেছে। জোটের বিমান হামলা এখন কমেছে, কিন্তু তার বদলে যেন ইসরায়েলি এবং আমেরিকান বোমাবর্ষণ শুরু হয়েছে। মনে হয়, আমরা যেন একটি ভিডিও গেম খেলছি, যেখানে আমরা এক দানবকে হারাতে না হারাতেই আরেক ভয়ঙ্কর দানবের মুখোমুখি হচ্ছি।

আমি ভেবেছিলাম এত আক্রমণের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পর আমরা হয়তো ভয়কে জয় করতে শিখে গেছি। কিন্তু না, আমি ভুল ছিলাম। এপ্রিল মাসের বোমা হামলার শব্দে আমার ছেলে তামিম দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে।

আমরা সবাই ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু তার চোখে আমি যে আতঙ্ক দেখেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ছয় বছর বয়সী তামিম এখনো যুদ্ধটা পুরোপুরি বুঝতে পারে না।

সে এখনো জগৎটাকে আবিষ্কার করছে, আর সেই জগৎটাই যেন সেদিন তার কাছে এক বিভীষিকা রূপে ধরা দিয়েছিল।

তামিম আমার মুখের দু’পাশে হাত রেখে, কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “এটা কি ভূমিকম্প?”

আমি তখনও তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। আমি কি তাকে মিথ্যা বলব? বলব, হ্যাঁ, এটা ভূমিকম্প? নাকি যুদ্ধের ভয়াবহতা, যুদ্ধবিমান আর ক্ষেপণাস্ত্রের কথা বলব?

তাকে কি সত্যিটা বলব, যে বিশ্ব আমাদের এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে?

আমি তাকে বললাম, এটা ভূমিকম্প নয়, একটি বিমান উড়ে গিয়েছিল, আর তা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছিল। আমি তাকে ক্ষেপণাস্ত্রের ভয়ংকর দিকটা বলতে চাইনি।

কারণ, আকাশে উড়োজাহাজ ওড়ার স্বপ্ন তার ছোটবেলা থেকেই। একদিন সে পাইলট হবে, এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে সে তার সামান্য জমানো টাকা জমাচ্ছিল।

বিমান শব্দটা শুনে তার ভয় কিছুটা কমেছিল, সে আবার তার উড়োজাহাজের কথা ভাবতে শুরু করল। তবে আমার আসল চিন্তা হলো, একদিন না একদিন সে ঠিকই বুঝবে, যখন সে শুনবে বিমানের শব্দ, তখন ইয়েমেনে আসলে কী হয়।

এরপর আমরা জানতে পারলাম, বোমাটি যেখানে পড়েছে, তার কাছেই আমার এক বন্ধুর বোনের বাড়ি ছিল। খবরটি শুনে আমি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। আমি দ্রুত আমার বন্ধুকে ফোন করলাম।

শুরুতে আমি তাকে কিছু বলতে পারিনি। ফোনে তার হাসিখুশি কণ্ঠ শুনে আমি বুঝতেই পারছিলাম না কিভাবে খবরটা দেব। কিন্তু আমার কাঁপা কণ্ঠ শুনে সে বুঝতে পারছিল, কিছু একটা ঘটেছে।

অবশেষে, আমাকেই সেই ভয়ংকর খবরটি দিতে হলো।

পরে আমরা জানতে পারি, তার ১৮ বছর বয়সী ভাগ্নে মোহাম্মদ, বোমা হামলায় নিহত হয়েছে। মোহাম্মদের স্বপ্ন ছিল স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করা।

ঘটনার এক ঘণ্টা আগেও সে একটি ইংরেজি ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র থেকে ক্লাস করে বাড়ি ফিরেছিল।

মোহাম্মদ হয়তো ভাবেনি, তার স্কলারশিপ অন্য কোনো জগতে হবে, যেখানে ভালো ফল করার চেয়ে ইয়েমেনি হওয়াই যথেষ্ট।

সংবাদ মাধ্যমে কয়েকবার তার নাম শোনা গেলেও, দ্রুতই তাকে সবাই ভুলে যায়।

আমি যখন এই লেখাটি লিখছি, তখন রাস ইসা বন্দরে বোমা হামলায় নিহত ৮০ জনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এই বন্দরটি আনসার আল্লাহ গোষ্ঠীর (হুতি বিদ্রোহী) জ্বালানি সরবরাহের একটি অংশ, কিন্তু তারা সেখানে কর্মরত সাধারণ শ্রমিকদের কথা বিবেচনা করেনি।

অধিকাংশ শ্রমিক তাদের পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছেন, তবে তারা পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিলেন। আর ২৬ বছর বয়সী আব্দুল ফাত্তাহর মতো কয়েকজনের কোনো খোঁজ মেলেনি।

তার শরীর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, তিনি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের স্থানে ছিলেন। যখন তাকে খোঁজা হয়, তখন তার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি – ফোন নেই, জুতো নেই, চুল নেই, এমনকি চামড়ার একটি টুকরোও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আব্দুল ফাত্তাহ যেন ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছেন।

পরিবারের জন্য এর চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না: প্রিয়জনের মরদেহ খুঁজে না পাওয়া, যা নিয়ে শোক করা যায়।

দিন যায়, আবার বোমা হামলা হয়। আমি বলতে পারব না, বোমা হামলার পর মুহূর্তগুলো কতটা ভারী হয়ে ওঠে।

এরপর কে মারা যাবে? মৃত্যু কখন, কোথায় ওঁৎ পেতে আছে? মানুষজন তাদের প্রিয়জনদের ফোন করতে থাকে। ফোন বন্ধ থাকলে পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু এত মৃত্যু আর ধ্বংসের মাঝেও ইয়েমেনিরা তাদের মানবিকতা আর সহনশীলতা দেখিয়ে যায়। আমি প্রায়ই শুনি, ‘গাজায় যা হচ্ছে, তার তুলনায় আমাদের কষ্ট কিছুই না।’

আমার ইয়েমেনি ভাই ও বোনেরা যেন তাদের কষ্টকে অন্য কষ্টের সঙ্গে তুলনা করে, যেন তাদের কষ্টকে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য অন্য কারো সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়।

আমি প্রায়ই নিজেকে প্রশ্ন করি: আমরা কি সবাই হতাশায় ভুগছি? নাকি আমাদের মধ্যে এমন কোনো অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা আছে, যা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে?

বোমা হামলা বাড়ুক বা কমুক, আমাদের হৃদয়ের শান্তি আর ফিরে আসে না। এই দুঃখ আমাদের শরীরে জমা হয়, আর আমরা আগামীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।

ইয়েমেনিরা এখন আর বাইরের বিশ্বের দিকে তাকায় না। আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট আর খবরগুলোতে আমরা শুধু কয়েকটি সংখ্যা।

আমাদের আর কিছুই করার নেই, শুধু লেখা ছাড়া। হয়তো লেখার মাধ্যমেই আমরা মোহাম্মদ, আব্দুল ফাত্তাহ এবং আরও কয়েক হাজার ইয়েমেনির স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে পারব।

হয়তো একদিন আমাদের লেখা বোমা হামলা বন্ধ করতে সাহায্য করবে।

এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি আল জাজিরার সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নাও হতে পারে।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *