তুরস্কে শান্তি আলোচনার জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি, তবে পুতিনের অনুপস্থিতি।
তুরস্কে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু হয়েছে, তবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এতে যোগ দেননি। বৃহস্পতিবারের এই বৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি উপস্থিত ছিলেন। পুতিনের এই অনুপস্থিতি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। তাদের মতে, রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করতে আন্তরিক নয়।
বৈঠকে যোগ দিতে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় পৌঁছান জেলেনস্কি। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রুশ প্রতিনিধি দল আলোচনা সভায় ‘অপ্রয়োজনীয়’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে বৈঠকের পরেই পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
ক্রেমলিন জানিয়েছে, রুশ দলের নেতৃত্ব দেবেন পুতিনের সহযোগী ভ্লাদিমির মেদিনস্কি। এছাড়া আরও তিনজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এই দলে থাকবেন। আলোচনাকে সামনে রেখে পুতিন আরও চারজন জুনিয়র পর্যায়ের কর্মকর্তাকে ‘বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।
এর আগে, জেলেনস্কি রুশ প্রেসিডেন্টকে তুরস্কের মাটিতে সরাসরি আলোচনার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আলোচনার জন্য তিনি তুরস্কে অপেক্ষা করবেন। কিন্তু পুতিন সেই বৈঠকে যোগ দেওয়ার বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা দেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুতিনের এই অনুপস্থিতিতে অবাক হননি। তিনি পুতিন ও জেলেনস্কিকে আলোচনার জন্য চাপ দিলেও, পুতিনের বৈঠকে যোগ না দেওয়ার বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।
কাতার রাজধানী দোহায় এক ব্যবসায়িক গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি মনে করি না, আমি সেখানে না থাকলে পুতিনের আসা সম্ভব।’
ইউক্রেনীয় প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রুস্তেম উমেরভ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি সিবিহা এবং প্রেসিডেন্ট অফিসের প্রধান আন্দ্রি ইয়ারমাক।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান তুরস্কেই আলাদাভাবে অনুষ্ঠিত ন্যাটো বৈঠকে বলেন, ‘এই দীর্ঘ কষ্টের পর, অবশেষে একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। আশা করা যায়, ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত আলোচনা একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।’
তবে জেলেনস্কি শুধুমাত্র পুতিনের সঙ্গেই বসতে রাজি আছেন বলে জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়াক।
ইউক্রেনীয় প্রতিনিধি দল কবে, কোথায় এবং কীভাবে তাদের রুশ প্রতিপক্ষের সঙ্গে মিলিত হবে, সে বিষয়ে এখনো বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে জেলেনস্কি ও এরদোয়ানের মধ্যে বৈঠকের পর বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তুরস্কের আগ্রহের কারণে আলোচনা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তা দুপুরের দিকে অনুষ্ঠিত হবে। তাস নিউজ জানিয়েছে, বসফরাসের তীরে একটি প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ে এই আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
আলোচনার পরিবর্তে রাশিয়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
বুধবার সন্ধ্যায় পুতিন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রেই বেলোওসভ, জেনারেল স্টাফ প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ এবং নিরাপত্তা পরিষদের সচিব সের্গেই শোইগুসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
ইউক্রেন এবং তার ইউরোপীয় মিত্ররা রাশিয়ার প্রতি ৩০ দিনের জন্য শর্তহীন যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছিল, যা শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারত। তবে পুতিন কার্যত সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দেন।
ক্রেমলিন বৃহস্পতিবারের আলোচনাকে ২০২২ সালে ইস্তাম্বুলে হওয়া শান্তি আলোচনার ‘পুনরায় শুরু’ হিসেবে বর্ণনা করেছে, যা দ্রুতই ভেঙে গিয়েছিল। রাশিয়া ইউক্রেন ও পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আনে। অন্যদিকে ইউক্রেন জানায়, রাশিয়ার দাবিগুলো ছিল এক প্রকার আলটিমেটাম, যা উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।
সে সময়ও রাশিয়ার প্রতিনিধি দলের প্রধান ছিলেন ভ্লাদিমির মেদিনস্কি।
পুতিনের এই প্রস্তাব আসে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার তিন মাস পর। ট্রাম্প নির্বাচনের সময় এই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ দ্রুত বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছে যে, কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হলে তারা শান্তি আলোচনা থেকে সরে আসতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা ইউরোপীয় নেতারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই বন্ধ না করলে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার তুরস্কের আন্টালিয়ায় ন্যাটো পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি সিবিহা, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
সিবিহা ট্রাম্পের মধ্যস্থতা প্রচেষ্টার প্রতি ইউক্রেনের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি মস্কোর প্রতি শান্তির লক্ষ্যে ‘ইউক্রেনের গঠনমূলক পদক্ষেপের প্রতি সাড়া দেওয়ার’ আহ্বান জানান।
বৃহস্পতিবার সকালে সিবিহা অন্যান্য ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাঁ-নয়েল বারোট। জ্যাঁ-নয়েল এক টুইট বার্তায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান এবং রাশিয়া তা মেনে না চললে ‘ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার’ হুমকি দেন।
মার্কো রুবিও বলেন, ‘আমরা এখন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছি এবং আমরা আশা করি, আলোচনার মাধ্যমে এই যুদ্ধের সমাপ্তি এবং ভবিষ্যতে কোনো যুদ্ধ প্রতিরোধের জন্য পদক্ষেপ নিতে পারব।’
ফিনিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিনা ভালটোনেনও আন্টালিয়ায় ন্যাটো বৈঠকে যোগ দেন। তিনি মস্কোর বিরুদ্ধে গুরুতর শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশ না নেওয়ার অভিযোগ করেন।
এলিনা ভালটোনেন বলেন, ‘একটি চেয়ার খালি রয়েছে, যা ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য। আমার মনে হয়, এখন সারা বিশ্ব বুঝতে পেরেছে যে, গুরুতর শান্তি আলোচনায় অংশ নিতে ইচ্ছুক নয়, এমন একটি পক্ষ আছে এবং সেটি অবশ্যই রাশিয়া।’
বারোটও তার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে বলেন, ‘ইউক্রেনীয়দের সামনে একটি খালি চেয়ার রয়েছে, যা ভ্লাদিমির পুতিনের দখলে থাকার কথা ছিল। ভ্লাদিমির পুতিন এতে গড়িমসি করছেন এবং স্পষ্টতই তিনি এই শান্তি আলোচনায় প্রবেশ করতে চান না।’
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস